নাটোরের হুলহুলিয়া যেন রূপকথার আদর্শ গ্রাম

এ যেন এক রূপকথার স্বর্গ গ্রাম। নেই চুরি, ডাকাতি বা মাদকের ছোবল। নেই ঝগড়া-বিবাদ। নেই কোনো রাজনৈতিক বিরোধ। এমনকি স্বাধীনতার পর এ গ্রামের কেউ কখনও মামলা করতে থানায় যায়নি। সুখে-দুঃখে একে অন্যের পাশে থাকেন গ্রামের সবাই। বিস্ময়কর এ গ্রামের নাম হুলহুলিয়া। আধুনিক হুলহুলিয়া গঠনে যাঁদের অবদান অনস্বীকার্য সেইসব কৃতি সন্তানদের মধ্যে শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবক মরহুম মছির উদ্দন মৃধা, শিক্ষাবিদ মরহুম মফিজ উদ্দিন পন্ডিত অন্যতম।

অবস্থান

নাটোর জেলা সদর থেকে প্রায় ৩৭ কিলোমিটার এবং সিংড়া থানা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে ছায়াঢাকা, পাখিডাকা, শান্ত গ্রাম হুলহুলিয়া। ১৩টি পাড়া নিয়ে গঠিত চলনবিল বেষ্টিত গ্রামটির আয়তন গ্রায় দুই বর্গকিলোমিটার। এটি নাটোরের সিংড়া উপজেলার ১০ নং চৌগ্রাম ইউনিয়নে অবস্থিত।

গ্রামের শিক্ষার হার ও স্যানিটেশন-ব্যবস্থা প্রায় শতভাগ। শীতে এ গ্রামে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি। কিন্তু পাখি মারার প্রবণতা নেই গ্রামবাসীর। ব্রিটিশ আমল থেকে স্বশাসন ব্যবস্থা চলে আসছে এখানে। এ গ্রামে বাল্যবিয়ে, যৌতুক, মাদক ব্যবসা নেই। সবাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসচেতন। এর প্রতিফলন দেখা যায় এ গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসা মেধাবীদের পরিসংখ্যানে।

গ্রামটি কেন আদর্শ?

নাটোর সিংড়া উপজেলার হুলহুলিয়া গ্রামটির পাশেই চলনবিল। হুলহুলিয়া চৌগ্রাম অন্তর্গত একটি গ্রাম। গ্রামের শতভাগ মানুষ শিক্ষিত। গ্রামে সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ রয়েছে। চেয়ারম্যান সদস্যদের নিয়ে একটি সালিসি বোর্ড গঠন করে গ্রাম উন্নয়নে কাজ করে থাকেন। হুলহুলিয়া গ্রাম সিংড়ার একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম, একটি আদর্শ গ্রাম। গ্রামে গেলে প্রথমেই চোখে পড়ে গ্রামের প্রবেশমুখে বিশাল একটি গেট। যেখানে লেখা রয়েছে আদর্শ গ্রাম হুলহুলিয়া। ২০১০ সালে তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এ গেটটি স্থাপন করে দেন।

গ্রামবাসী মনে করেন, শিক্ষার প্রতি অনুরাগ ও শতভাগ শিক্ষিত হওয়ার কারণে মানুষের চিন্তা-ভাবনা ও মননে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। একারণে গ্রামের মানুষজন কলহ ও সংঘাত থেকে দূরে থাকেন। এছাড়া গ্রামটি পরিচালনার জন্য তাদের নিজস্ব সংবিধান রয়েছে। যা সবাই মেনে চলেন। গ্রামে কোনো সমস্যা-সংকট দেখা দিলে গ্রামবাসী মিলে সংবিধানের আলোকে তা সমাধান করেন। এজন্য ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত তাদের একটি কমিটিও রয়েছে। এছাড়া স্কুল, মাদ্রাসা, বাজার, মসজিদ ও গোরস্থানভিত্তিক তাদের আলাদা আলাদা পরিচালনা কমিটিও রয়েছে। এ কমিটিও ভোটের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। গ্রামবাসী গ্রামের মধ্যে কোনো বিভাজন তৈরি করেন না। দরিদ্রদের সহায়তায় সবাই একসাথে এগিয়ে আসেন। গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় ৬ হাজার হলেও প্রায় ৪ হাজার মানুষ গ্রামের বাইরে চাকরি করেন।  তারাও অর্থনৈতিকভাবে গ্রামবাসীকে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করেন। ছেলেমেয়েদের জন্য এসএসসি পাশ করা বাধ্যতামূলক। এসএসসি পাশ না করালে কেউ তার মেয়েও বিয়ে দিতে পারেন না।

গ্রামটি শতভাগ মাদকমুক্ত ও সবার জন্য স্যানিটেশনের ব্যবস্থা আছে।

সংঘাতহীন এই গ্রামে রয়েছে ১৩টি পাড়া। আর নিজস্ব গঠনতন্ত্র দিয়ে পরিচালিত হয় গ্রামটি। ১৫ পৃষ্ঠার গঠনতন্ত্র দ্বারা একটি পরিবারে আবদ্ধ হয়েছে ওই গ্রামের বাসিন্দারা। ফলে সেখানে ২শ’ বছর ধরে প্রবেশ করেনি কোনো পুলিশ। এমনি সেখানে হয়নি একটি মামলাও।

ছবি: টিবিএস

হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ

হুলহুলিয়া গ্রামের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ’হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ’ নামের সামাজিক প্রতিষ্ঠানটি। একে উচ্চ আদালতও বলা হয়। এই পরিষদের মাধ্যমেই গ্রামের সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান এবং গ্রামবাসীর মধ্যে কখনো কলহ দেখা দিলে তা মীমাংসা করা হয়।

১৯৪০ সালে মছির উদ্দিন মৃধা নামের গ্রামের এক ব্যক্তি এই সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ গঠন করেন ও গ্রাম পরিচালনার সংবিধান তৈরি করে লিখিত রূপ দেন।

সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ পরিচালনার একটি কমিটিও রয়েছে। কমিটিতে একজন চেয়ারম্যান ও একজন ভাইস চেয়ারম্যানসহ সদস্য রয়েছেন আরও ২১ জন। তারা সবাই গ্রামের পুরুষ ভোটারদের দ্বারা দুই বছরের জন্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, যারা জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হন তারাই সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের নেতৃত্ব নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। এছাড়া পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটিও রয়েছে তাদের। এছাড়া গ্রামের বিচার বিভাগীয় আটটি পাড়াতেও আলাদা আলাদা কমিটি রয়েছে। যাকে বলা হয় নিম্ন আদালত। এই কমিটি পাড়ার আকার-আকৃতি অনুসারে ৫ থেকে ৮ সদস্যের হয়ে থাকে।

পরিষদের পটভূমি

জানা গেছে, ১৯১৪-১৫ সালের দিকে একবার প্রবল বন্যায় ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় গ্রামে অভাব দেখা দেয়। গ্রামের অনেক চাষী ধান-বীজের অভাবে জমি ফেলে রাখতে বাধ্য হন। সবার মনে কষ্ট, হতাশা। বিষয়টি গ্রামের মাতবর মছির উদ্দিন মৃধার মনে দাগ কাটে। একদিন গ্রামের প্রতিটি পরিবার থেকে একজন করে লোক ডেকে সভায় বসেন তিনি। সিদ্ধান্ত হয়, যাদের ঘরে অতিরিক্ত ধান-বীজ আছে, তারা বিনাশর্তে অন্যদের ধার দেবেন। সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়, খালি জমি ফসলে ভরে ওঠে। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে গ্রামের উন্নয়নে ১৯৪০ সালে ‘হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ’ নামে একটি পরিষদ গঠিত হয়।

১৯৫৭ সাল থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে পরিষদের সদস্যদের মধ্য থেকে বিচারক প্যানেল গঠিত হয়ে আসছে। গ্রামে কোনো বিরোধ হলে এই প্যানেল আলোচনার মাধ্যমেই তা মীমাংসা করে থাকে। ব্রিটিশ আমল থেকে হুলহুলিয়া গ্রামে নিজস্ব ব্যবস্থা চালু আছে। এ নিয়ে গ্রামবাসীর মধ্যে কখনো কোনো বিরোধ সৃষ্টি হয়নি।

দুইশ’ বছর আগ থেকে সামাজিকভাবে এই গ্রামের সকল সমস্যার সমাধান চলে আসছে। তবে ১৯৪০ সালে মরহুম জালাল উদ্দিন মৃধাকে প্রথম চেয়ারম্যান করে হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের কার্যক্রম শুরু হয়। আর এই সময় থেকে তাদের গঠনতন্ত্র দিয়ে চলছে এই গ্রাম। 

ছবি: টিবিএস

হুলহুলিয়া গ্রামের কোনো সদস্যের কোনো সমস্যা দেখা দিলে প্রথমে ওই পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি মীমাংসা করার চেষ্টা করেন। তারা না পারলে তার বাদবাকিরা চেষ্টা করেন। তারা না পারলে তখন পাড়ার যে কমিটি আছে, সেই কমিটি বিষয়টি মীমাংসা করার চেষ্টা করেন। তারাও ব্যর্থ হলে তখন সামাজিক উন্নয়ন পরিষদে বিষয়টি তোলা হয়। সেখানে যে রায় দেওয়া হয় সেটি সবাই মেনে নেয়। একারণেই কাউকে কোর্ট-কাছারিতে যেতে হয়না। পুলিশ ডাকারও প্রয়োজন হয় না। এটি গত ২০০ বছরেের ইতিহাস।

হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের দ্বিতীয় তলায় রয়েছেন কমিউনিটি সেন্টার ও রেস্ট হাউজ। অন্য গ্রামের বাসিন্দারা এগুলো ব্যবহার করলে ভাড়া নেওয়া হলেও এই গ্রামের বাসিন্দারা বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারেন। 

হুলহুলিয়া ডায়মন্ড ক্লাব 

এই গ্রামে ১৯৪০/৪২ সালে ‘দ্য হুলহুলিয়া ডায়মন্ড ক্লাব’ গঠন করা হয়। মরহুম মফিজ উদ্দিন প্রামানিক ক্লাবটি গঠন করেন। ক্লাবের উদ্যোগে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ১৩ সদস্যের একটি কমিটি এই ক্লাব পরিচালনা করে। হুলহুলিয়ায় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে আসছে শেকড় ও বটবৃক্ষ নামের দুটি অরাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন। এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য সবাই চাকরিজীবী। তাদের অনুদানে গ্রামের অভাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি, অসহায় মানুষকে সহায়তা ও বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়।

ডাকঘর

এ গ্রামে একটি ডাকঘর স্থাপনের জন্য শিক্ষা অনুরাগী জনাব মোঃ মফিজ উদ্দিন প্রামানিক (হেড পুন্ডিত)এর অক্লান্ত পরিশ্রমে এবং সকল গ্রামবাসীর সহযোগীতায় ১৯৫৬ সালে ডাকঘরটি স্থাপিত হয়৷ এ ডাকঘরটির প্রথম পোষ্টমাষ্টার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন মরহুম রবিউল্লাহ সরদার এবং এ সময় দীর্ঘদিন ডাকহরকর এর দায়িত্ব পালন করেন মরহুম মমতাজ আলী সরদার৷ এছাড়া এ ডাকঘরের দীর্ঘদিন ধরে পোষ্ট মাষ্টারের দায়িত্ব পালন করেছেন মরহুম আজিুজুল হক শাহ এবং ডাকহরকর এর দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন মরহুম ইস্মাইল হোসেন সোনার৷

দাতব্য চিকিৎসালয়

দুই দশক পূর্বেও উপজেলার সাথে যোগাযোগ ছিল শুষ্ক মৌসুমে পায়ে হেটে এবং বর্ষা মৌসুমে নৌকা ছাড়া বিকল্প ছিল না। কোন মানুষ হটাৎ অসুস্থ হলে বাঁশের মাচায় করে কাঁধে নিয়ে রোগীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিতে হতো। হুলহুলিয়া তথা পাশ্ববর্তী গ্রামের জনগনের জন্য কোন প্রকার প্রাথমিক চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যাবস্থা ছিল না। এ প্রতিকুল অবস্থার মোকাবিলা করতে তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মরহুম মহসীন আলী সরকার, ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মরহুম মুনসুর আলী খলিফা এর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এবং গ্রামবাসীর অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে ১৯৫৬ সালে গড়ে তোলা হয় একটি দাতব্য চিকিৎসালয়। এ চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে এ গ্রাম ছারাও পাশ্ববর্তী সারদানগর, পাঁড়েড়া, মুষ্টিগড়, স্থাপন্দিঘী, গোয়ালবাড়ীয়ার জনগন চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন। বর্তমানে একজন মেডিক্যাল অফিসার(এম.বি.বি.এস), একজন প্যারামেডিক্‌স ও একজন ফার্মাসিস্ট এর মাধ্যমে এ দাতব্য চিকিৎসালয়টি থেকে সেবা প্রদান করা হছে।

মসজিদ

হুলহুলিয়া গ্রামের শতভাগ মানুষ মুসলমান৷ ধর্মের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও ধর্মভীরু, তবে ধর্মান্ধ নয়৷ ইসলাম কর্তৃক নির্দেশিত পথে নিজে অনুসরণ এবং অন্যকে অনুকরণ করতে সদা সচেষ্ট৷ এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মরহুম সমতুল্ল্যাহ প্রামানিক সর্বপ্রথম ১৩১৭ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১৯১০ সালে আধুনিক স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন একটি সুরম্য পাকা মসজিদ নির্মাণ করেন৷ নির্মাণপূর্ব এ মসজিদের ব্যয় নির্বাহ করার জন্য তিনি প্রায় ষোল বিঘা জমি এককালীন দান করে যান৷ মরহুম সমতুল্ল্যাহ প্রামানিক জীবদ্বশায় পর্যন্ত তিঁনি এ মসজিদের মোয়াজ্জিম এর দায়িত্ব পালন করেন৷ এ ছাড়াও আরো অনেক দানবীর ব্যক্তি এ মসজিদের জন্য জমি দান করেছেন৷ বর্তমানে মসজিদের মোট জমির পরিমান ২৬ বিঘা৷ গ্রামবাসীর নামাজের স্থান সংকলন না হওয়ায় সকল গ্রামবাসীর সক্রিয় অংশগ্রহনে এবং আলহাজ্জ ডাঃ মোহাঃ শরফুল ইসলাম সরদার (বাচ্চু ডাক্তার) এর অনুদানে ১৯৭৪ সালে দ্বিতীয় বার এ মসজিদের পূনঃনির্মান করা হয়৷ প্রতি রমজান মাসে এ মসজিদে খতমে তারাবিহ অনুষ্ঠিত হয় ৷ ২০১১ সালে মসজিদের আরো আধুনিকায়ন করার জন্য তৃতীয় বারের মতো পূর্ননির্মানের কাজ হয়।

হুলহুলিয়া ডিজিটাল হাব 

গ্রামটির কর্মক্ষম কোনো ব্যক্তি বেকার থাকেন না। ১টি উচ্চ বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার পাশাপাশি ২০১৬ সালে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্থাপন করা আইসিটি ট্রেনিং সেন্টার। আইসিটি ট্রেনিং সেন্টারে ৫ বছর ৬৫০ জন শিক্ষার্থীকে অনলাইনে আয়ের প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মক্ষম করা হয়েছে। 

২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয়ে তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৬ সালে হুলহুলিয়াতে ডিজিটাল হাব প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার এটি উদ্বোধন করেন। এই ডিজিটাল হাব সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। এতে ১১টি কম্পিউটার, একটি প্রজেক্টর, একটি লাইভ টেলিভিশন রয়েছে। এছাড়া একটি ডিজিটাল ইসিজি রুমও রয়েছে। হুলহুলিয়া গ্রামের একটি নিজস্ব ওয়েবসাইটও রয়েছে, যদিও ওয়েবসাইটটি পুরোপুরি সচল নয়

ডিজিটাল হাব থেকে সরাসরি গ্রামের মানুষদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এছাড়া যেকোনো ছাত্রছাত্রীদের কম্পিউটার বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। আর ওয়েবসাইট থেকে গ্রাম বিষয়ে তথ্য জানার সুযোগ আছে, যদিও ওয়েবসাইটটি পুরোপুরি সচল নয়।।

পরিষদ থাকায় হুলহুলিয়া গ্রামে কোনো বিবাদ বা সংঘর্ষ হয় না বললেই চলে। যেটুকু হয় সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের মাধ্যমে তা সমাধান করা হয়। শতভাগ শিক্ষিত হওয়ায় গ্রামটি সিংড়া উপজেলার মধ্যে আদর্শ গ্রাম হিসেবে স্বীকৃত।

শতভাগ শিক্ষিত 

১৮৬৯ সালে হুলহুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। কিন্তু উচ্চবিদ্যালয় না থাকায় প্রাথমিকের পর অনেক শিক্ষার্র্থী ঝরে পড়ত। পরিষদের উদ্যোগ আর গ্রামের মানুষের চেষ্টায় ১৯৬৬ সালে হুলহুলিয়া উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

গ্রামের মানুষজন শতভাগ শিক্ষিত। সব ছেলেমেয়ের জন্যই এসএসসি পাশ করা বাধ্যতামূলক। কেোনো পরিবারের ছেলেমেয়ে দারিদ্র্যতার কারণে তার সন্তানকে পড়ালেখা করাতে না পারলে তখন দরিদ্র তহবিল কমিটি থেকে সেই ছেলেমেয়ের শিক্ষার দায়িত্ব নেওয়া হয়। চাকুরিতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে সহায়তা করা হয়।

এসএসসি পাশের আগে কেউ তার মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবে না। যদি কেউ কোনো কারণে তার মেয়েকে ১৮ বছরের পূর্বে বিয়ে দিতে চাইলে, কেন বিয়ে দিতে চাচ্ছে তা জেনে সমাধান করা হয়। কিন্তু এসএসসি পাশ না করে বিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। বিয়ের সময় যৌতুক নেওয়া ও দেওয়াও এখানে সম্পূর্ণ নিষেধ। 

গ্রামে একটি প্রাইমারি স্কুল, একটি হাইস্কুল, একটি মাদ্রাসা ও একটি মসজিদ রয়েছে। গ্রামটি থেকে দুইশোর অধিক বিএসসি প্রকৌশলী, শতাধিক এমবিবিএস ডাক্তার,প্রায় ২০ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ১১ জন বিচারকসহ নানা পেশার মানুষ ও প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব রয়েছেন।

প্রাথমিক বিদ্যালয়

শিক্ষা বিস্তারের সোপান হিসাবে বিবেচিত, যেখান থেকে একজন শিশুর প্রথম হাতেখড়ি সেই হুলহুলিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ স্কুলের ভবন নির্মানের জন্য জায়গা দান করেন বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী জনাব আফতাব উদ্দিন মৃধা। সিংড়া উপজেলার ভিতরে হুলহুলিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এখন একটি মডেল স্কুল হিসাবে পরিচিত। একক বিদ্যালয় হিসাবে এই স্কুল থেকে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী প্রাথমিক বৃত্তি পেয়েছে। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মরহুম আকবর আলী স্যার এবং সহকারি প্রধান শিক্ষক জনাব মোঃ হাবিবুর রহমান স্যার এর দক্ষ এবং যোগ্য নেতৃত্বে সর্বাধিক আট(০৮) জন প্রাথমিক বৃত্তি পেয়ে উপজেলা পর্যায়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল। এর ধারাবাহিকতা অদ্যাবধি পর্যন্ত বিদ্যমান আছে। অভিজ্ঞ শিক্ষক মন্ডলী ও কর্মচারী নিয়ে মান সম্পন্ন শিক্ষা প্রদান করছে এ বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রায় পাচ শতাধিক ছাত্র-ছাত্রীদের। এছাড়া শিক্ষার জন্য নিবেদিত একদল অভিজ্ঞ এবং যোগ্য অবিভাবকের ব্যবস্থাপনায় এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

উচ্চ বিদ্যালয়

প্রাথমিক শিক্ষা একজন মানুষের তার জিবনের মৌলিক শিক্ষার শুরু। এই শিক্ষা কে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন উচ্চ বিদ্যালয়। তাই এই গ্রামে একটি উচ্চ বিদ্যালয় স্থপনের জন্য বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী জনাব মোঃ ফরিদ উদ্দিন শাহ এর অক্লান্ত পরিশ্রমে এবং সকল গ্রামবাসীর সহযোগিতায় ১৯৬৬ সালে মরহুম আমীর আলী সরদার এবং মরহুম জুমুর আলী সরদারের দানকৃত জায়গায় হুলহুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। হুলহুলিয়া গ্রামের প্রথম বি.এস.সি (১৯১৪) মরহুম মছির উদ্দিন মৃধার সুদীর্ঘ উনিশ(১৯) বছরের বিনা পারিশ্রমিকে গড়ে উঠেছে আজকের হুলহুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়। দূর থেকে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য সম্পূর্ন বিনামূল্যে একটি সুরম্য ছাত্র হোস্টেল এবং লজিং এর মাধ্যমে স্কুল কমিটির সার্বিক ব্যাবস্থাপনায় থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা করে আসছে শিক্ষানুরাগি গ্রামবাসিগণ। এ বিদ্যালয় এখন পর্যন্ত শতশত ডাক্তার, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, মাষ্টার্স, গ্রাজুয়েটদের জন্ম দিয়ে এসেছে। কয়েকটি ভবনে মানবিক এবং বিজ্ঞান এই দু’টি শাখার মাধ্যমে বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। অভিজ্ঞ শিক্ষক মন্ডলী ও কর্মচারী নিয়ে মান সম্পন্ন শিক্ষা গ্রহণ করছে এ বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রায় সাড়ে চারশত ছাত্র-ছাত্রী।

 হুলহুলিয়ায় জেলা প্রশাসক

নাটোরের সেই আদর্শ গ্রাম হুলহুলিয়া দেখতে গেলেন জেলা প্রশাসক

২৪ আগস্ট ২০২১ হুলহুলিয়া পরিদর্শন করেন নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ । তিনি এ গ্রাম পরিদর্শন করে কিছু দিকনির্দেশনা দেন।     

এসময় তিনি, হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ কার্যালয়, ডিজিটাল হাব সেন্টার, কমিউনিটি সেন্টার, বিচার কক্ষ, পাঠাগারসহ বিভিন্ন স্থাপনা পরিদর্শন করেন এবং সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলেন। এর আগে তিনি তাজপুর ইউনিয়ন পরিষদ পরিদর্শন করেন।

এসময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) নাদিম সারোয়ার, সিংড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এম এম সামিরুল ইসলাম, চৌগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম ভোলা, হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আল তৌফিক পরশ, ভাইস চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির শাহ্ উপস্থিত ছিলেন।

জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, আমি বিমোহিত হয়েছি। এটা শুধু নাটোর জেলার জন্য না, সারাদেশের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। বিগত ২০০ বছরের ইতিহাসে এ গ্রামে কোনো মামলা নাই। গ্রামের বিচার ব্যবস্থা, শতভাগ শিক্ষিতের হার, নির্বাচনের পদ্ধতি সবকিছু মিলে নাটোরের জন্য অহংকারের বিষয়। পরবর্তীতেও তারা এটা বজায় রাখবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন জেলা প্রশাসক।

প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব 

গ্রামের দেড় শতাধিক সন্তান প্রকৌশলী, শতাধিক চিকিৎসক। আছেন কৃষিবিদ, আইনবিদ, প্রতিরক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও। বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার মরহুম মোহাম্মদ হানিফ উদ্দিন মিয়া এই গ্রামের বাসিন্দা। সম্প্রতি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার তার স্মরণে ডাক অধিদপ্তরের স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত করেন। এছাড়া তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে হুলহুলিয়া গ্রামে ডিজিটাল হাব স্থাপন করা হয়েছে। মোস্তফা জব্বার নিজে গিয়ে সেই ডিজিটাল হাবের উদ্বোধন করেন। এছাড়া গুণী ব্যক্তিদের মধ্যে আইন বিভাগের সাবেক সচিব মরহুম একে কাদের তালুকদার, বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মির্জা মনজুরুল কাদের জুয়েল, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম এমএম রহমতুল্লাহ ও  নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন ইঞ্জি. জমসেদ আলী রয়েছেন।

এছাড়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেন্টাল ইউনিটের চেয়ারম্যান ডা. মাহবুবুর রহমান, হাইকোর্টের বিচারপতি ফাহমিদা কাদের, অস্ট্রেলিয়ার সিডনির সেন্ট্রাল হাসপাতালের ডীন ড. মন্টু তালুকদার ও কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারেের পরিচালক ড. জিল্লুর রহমান এই গ্রামের বাসিন্দা।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *