বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণের উৎসব হলো নৌকা বাইচ। নদীমাতৃক এই দেশে বর্ষা ও শরতের স্রোতস্বিনী নদীকে ঘিরে যুগ যুগ ধরে এই প্রতিযোগিতা হয়ে আসছে। কিন্তু আধুনিকতার ভিড়ে অনেক জায়গায় এই ঐতিহ্য ম্লান হয়ে গেছে। নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার বিলসা গ্রামে প্রায় ৪০ বছর পর আবারও সেই হারানো ঐতিহ্য ফিরে এসেছে। চলনবিলের বুক চিরে ঢাক-ঢোলের তালে অনুষ্ঠিত হলো এক মহোৎসব—নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা ২০২৫।

আয়োজনে নতুন প্রাণ
শুক্রবার (১২ সেপ্টেম্বর) বিকেলে নাটোরের চলনবিল অধ্যুষিত গুরুদাসপুর উপজেলার বিলসায় ওই নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। নৌকা বাইচের উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি স্বাস্থ্যসচিব মো. সাইদুর রহমান। ঢাক ঢোল,বাউল গান আর মাঝি মাল্লার বৈঠার তালে পানির ছকছক শব্দে শুরু হয় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা। ১২ টি নৌকার অংশগ্রহনে সন্ধা পর্যন্ত চলে বাইচ প্রতিযোগিতা।
এটি শুধু বিনোদনের উৎসব নয়, বরং পরিবেশ রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করেছে।
প্রতিযোগিতা ও দলসমূহ
এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে নাটোর জেলা প্রশাসন ও গুরুদাসপুর উপজেলা প্রশাসন। স্থান নির্ধারণ করা হয় আত্রাই নদীর উপর অবস্থিত মা জননী সেতুর নিচের অংশে। প্রতিযোগিতার মূল প্রতিপাদ্য ছিল:
“নদী দূষণ রোধ করি, নির্মল বাংলাদেশ গড়ি”।
আয়োজক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন জেলার ২১টি দল প্রতিযোগিতায় নাম লেখালেও মূল প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ১২টি নৌকা।
- প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় মোট ১২টি পানসি নৌকা।
- প্রতিটি নৌকায় ছিল কয়েক ডজন মাঝি, যারা একসঙ্গে বৈঠা চালিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করেছে।
- শক্তি, কৌশল আর তালমিল ছিল প্রতিযোগিতার প্রধান উপাদান।
বিজয়ী
চলনবিলের রুহাই গ্রামের অংশ থেকে ছাড়া হয় নৌকা। দুই কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে মা জননী সেতুর কাছে এসে শেষ হয়। পয়েন্ট ভিত্তিক প্রতিযোগিতায় তিনবার অংশগ্রহণ করে প্রথম হন সিরাজগঞ্জ জেলার নিউ একতা এক্সপ্রেস, দ্বিতীয় হন বাংলার বাঘ ও তৃতয় হয়েছে আল মদিনা নৌকা।
- ১ম স্থান: নিউ একতা এক্সপ্রেস (পুরস্কার: মোটরসাইকেল)
- ২য় স্থান: বাংলার বাঘ (পুরস্কার: ফ্রিজ)
- ৩য় স্থান: আল মদিনা (পুরস্কার: এলইডি টেলিভিশন)
পুরস্কার বিতরণ করেন জেলা প্রশাসক আসমা শাহীন এবং স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান।
দর্শক ও উৎসবের আমেজ
প্রতিযোগিতাকে ঘিরে চলনবিলের দুই পাড়ে নেমেছিল মানুষের ঢল। এই গ্রামীণ উৎসব দেখতে নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার লাখখানেক দর্শকের সমাগম হয়েছিল। তুমুল বৃষ্টিও এই নির্মল বিনোদন থেকে তাঁদের বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। প্রতিযোগিতা শুরুর পাঁচ ঘণ্টা আগে থেকে মানুষ দুই পাড়ে জড়ো হতে শুরু করেন। সন্ধ্যা অবধি অনুষ্ঠিত হয় এই ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ। এত দর্শকের উপস্থিতিই প্রমাণ করে চলনবিলের মানুষের কাছে এখনো এটিই সেরা প্রতিযোগিতা।
- হাজারো মানুষ, নারী-পুরুষ, শিশু থেকে প্রবীণ পর্যন্ত ভিড় জমিয়েছিল।
- ঢাক-ঢোল, বাঁশির সুর ও দর্শকদের উল্লাসে চারপাশ মুখর হয়ে ওঠে।
- বৃষ্টিও উৎসাহ কমাতে পারেনি, বরং উৎসবকে করেছে আরও রঙিন।
অনেকে বলছিলেন, জীবনে প্রথমবার এমন আয়োজন দেখছেন, আবার অনেক প্রবীণ বললেন, চার দশক পর তাদের শৈশবের স্মৃতি ফিরে এসেছে।
সাংস্কৃতিক ও সামাজিক তাৎপর্য
নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা কেবল একটি ক্রীড়া আয়োজন নয়, এর রয়েছে বিস্তৃত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব:
- ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবন: দীর্ঘদিন পর গ্রামীণ সংস্কৃতি আবার সামনে এলো।
- সম্প্রীতি বৃদ্ধি: একই জায়গায় হাজারো মানুষের মিলনমেলা হয়েছে, যা সামাজিক বন্ধনকে আরও দৃঢ় করেছে।
- অর্থনৈতিক প্রভাব: স্থানীয় খাবারের দোকান, চায়ের আড্ডা, হস্তশিল্প ব্যবসা— লাভবান হয়েছে দর্শকদের ভিড়ে।
- পর্যটন সম্ভাবনা: এ ধরনের আয়োজন নিয়মিত হলে চলনবিল পর্যটনের নতুন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।
চ্যালেঞ্জ ও উন্নয়নের সুযোগ
বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ
- সরু ও কাঁচা সড়ক দর্শকদের যাতায়াতে সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
- পর্যাপ্ত ছাউনি ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ছিল না।
- নিরাপত্তা ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে আরও উন্নতি দরকার ছিল।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
- অবকাঠামো উন্নয়ন: রাস্তা, সেতু, বসার জায়গা উন্নত হলে দর্শক অভিজ্ঞতা বাড়বে।
- বড় পরিসরে প্রচার: জাতীয় পর্যায়ে প্রচার করলে দর্শকসংখ্যা বহুগুণ বাড়তে পারে।
- স্পনসরশিপ: স্থানীয় ও জাতীয় প্রতিষ্ঠান যুক্ত হলে আয়োজনে ধারাবাহিকতা ও গুণগত মান বজায় থাকবে।
মতামত
দর্শনার্থী ও এলাকাবাসীরা জানান- চলনবিলে বহু বছর পর গ্রাম বাংলার ঐহিত্যবহনকারী মনোমুগ্ধকর নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা দেখতে পেরে খুবই আনন্দিত। এত সুন্দর আয়োজন করার জন্য আয়োজক কমিটিকে ধন্যবাদ জানান তাঁরা।
প্রতিযোগিতারা জানান, নাটোরের বিভিন্ন নদীতে হলেও এই প্রথম চলনবিলে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা হয়েছে। জয় পরাজয় থাকবেই। তবে প্রতিযোহিতায় অংশ নিতে পেরে তার খুশি।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ থেকে নৌকাবাইচ দেখতে এসেছিলেন কলেজশিক্ষক মাহফুজুর রহমান। তাঁর ভাষ্য, একটি প্রতিযোগিতা দেখার জন্য নানা বয়সী মানুষ এভাবে ভিড় করতে পারে—তা নিজের চোখে না দেখলে বোঝার উপায় ছিল না।
প্রথমবারের মতো নৌকাবাইচ দেখতে এসেছিলেন বুয়েটের শিক্ষার্থী সাদমান হোসেন। তিনি বলেন, মাঝি মাল্লাদের দক্ষতা আর দর্শকদের উচ্ছ্বাস তাঁকে অভিভূত করেছে।
পাশের খুবজিপুর গ্রামে বড় হয়েছেন ব্যাংকার কামাল হোসেন (৫৫)। তিনি নৌকাবাইচ দেখে বলেন, গত ৪০ বছরে এত বড় আয়োজন আশপাশে কোথাও দেখেননি।
নৌকাবাইচের সমন্বয়ক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আবুল হায়াতের জন্মও চলনবিল এলাকাতেই। তাঁর ভাষ্য, বিল পাড়ের মানুষদের বিনোদন দিতে নৌকাবাইচকেই বেছে নিয়েছেন।
আয়োজক জেলা প্রশাসক আসমা শাহীন ও গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাহমিদা আফরোজ জানান- গ্রাম বাংলার পুরানো ঐতিহ্য ফিরে আনতে মানুষকে নির্মল আনন্দ দিতে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। এধরনের প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
প্রধান অতিথি সচিব সাইদুর রহমান জানান- আমি চলনবিলের সন্তান। বহু বছর পর এধরনের নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা দেখে আমি অভিভূত ও আনন্দিত। নিজ জন্মভূমি চলনবিলে এমন নৌকা বাইচের আয়োজন করায় আয়োজক কমিটিকে ধন্যবাদ জানান তিনি। তাঁর আগ্রহেই জেলা সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরের বিলসা গ্রামে নৌকাবাইচ আয়োজিত হয়। তাঁর সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে এসেছিলেন রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার আজিম উদ্দিন, রাজশাহীর রেঞ্জ ডিআইজি শাহজাহান আলী, নাটোরের জেলা প্রশাসক আসমা শাহীন, পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম প্রমুখ।
উপসংহার
চলনবিলে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা ছিল কেবল একটি খেলা নয়, বরং হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের প্রত্যাবর্তন। এটি গ্রামীণ জীবনে আনন্দ এনেছে, সংস্কৃতিকে পুনর্জাগরিত করেছে এবং ভবিষ্যতের পর্যটনের সম্ভাবনা উন্মুক্ত করেছে।
চার দশক পর মানুষ দেখেছে বৈঠার ঝড়, ঢোলের তালে প্রতিযোগিতা আর পুরস্কারের উচ্ছ্বাস। এই আয়োজন প্রমাণ করেছে—গ্রামবাংলার ঐতিহ্য এখনও জীবন্ত, শুধু প্রয়োজন তাকে পুনরুজ্জীবিত করার ইচ্ছাশক্তি।