হানিফউদ্দিন মিয়া-বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার

মো. হানিফ উদ্দিন মিয়া। কম পরিচিত কিন্তু এখনকার কম্পিউটার প্রযুক্তির প্রেক্ষিতে বিশাল প্রভাবশালী বাংলাদেশি তিনি। তিনি বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার। বস্তুত, তৎকালীন পুরো পাকিস্তানেরই প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার তিনি।

দেশের তথ্যপ্রযুক্তিতে হানিফউদ্দিন মিয়ার অবদান প্রথমবারের মত বড় পরিসরে তুলে ধরা হয় ১৯৯৭ সালে, বিটিভির একটি অনুষ্ঠানে। সে অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মোস্তাফা জব্বার জানালেন হানিফউদ্দিন মিয়া ও দেশের প্রথম কম্পিউটারের গল্প। তিনি বলেন, ‘১৯৯৭ সালের কথা। বাংলাদেশ টেলিভিশনে “কম্পিউটার” নামে সাপ্তাহিক একটি অনুষ্ঠান শুরু হলো। আমি ঠিক করলাম যাঁর হাত ধরে দেশে এসেছিল কম্পিউটার, তাঁকে দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করব। বিটিভির এটাই ছিল তার জীবনের প্রথম এবং শেষ সাক্ষাৎকার।’

বাল্যকাল ও পরিবার

বাংলাদেশের গৌরব, নাটোরের এই কৃতী সন্তান পরমাণু বিজ্ঞানী হানিফউদ্দিন মিয়া ১৯২৯ সালের ১ নভেম্বর নাটোরের সিংড়া উপজেলার হুলহুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নাটোরের হুলহুলিয়া যেন রূপকথার আদর্শ গ্রাম, নাটোর জেলা সদর থেকে প্রায় ৩৭ কিলোমিটার এবং সিংড়া থানা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে ছায়াঢাকা, পাখিডাকা, শান্ত গ্রাম হুলহুলিয়া। ১৩টি পাড়া নিয়ে গঠিত চলনবিল বেষ্টিত গ্রামটির আয়তন গ্রায় দুই বর্গকিলোমিটার। এটি নাটোরের সিংড়া উপজেলার ১০ নং চৌগ্রাম ইউনিয়নে অবস্থিত। । স্কুলশিক্ষক বাবা রজব আলী তালুকদার ও মা নজিরন বিবির দুই ছেলে ও এক কন্যাসন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ তিনি। সংসারে অভাব না থাকলেও উচ্চশিক্ষার জন্য জায়গির থাকতে হয় তাকে।

হানিফ উদ্দিন মিয়ার স্ত্রীর নাম ফরিদা বেগম। তিনি এক পুত্র ও দুই কন্যাসন্তানের জনক। পুত্র শরীফ হাসান সুজা প্রকৌশলী । মেয়ে ডোরা শিরিন পেশায় চিকিৎসক এবং নিতা শাহীন গৃহিণী।

পড়াশোনা

১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ম্যাট্রিকুলেশন (বর্তমান এসএসসি) এবং ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন আইএসসি (বর্তমান এইচএসসি) পাস করেন প্রথম শ্রেণি নিয়ে। তারপর অনার্সে পড়াশোনার জন্য বেছে নিয়েছেন কম্পিউটার বিজ্ঞান ও গণিত। দুই বছর পড়াশোনার পর অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিতে স্বর্ণপদকসহ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেছেন। তারপর পড়াশোনার জন্য পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে।

১৯৬০ সালে তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার প্রাগের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন থিওরি অ্যান্ড অটোমেশন এবং চেকোস্লোভাক একাডেমি অব সায়েন্স থেকে অ্যানালগ ও ডিজিটাল কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) কম্পিউটার সেন্টার থেকে সিস্টেম অ্যানালাইসিস, নিউমারাল ম্যাথমেটিকস, অ্যাডভান্সড কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে প্রশিক্ষণ নেন। তারপর ১৯৭৫ সালে লন্ডনের আইবিএম রিসার্চ সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ নেন অপারেটিং সিস্টেম ও সিস্টেম প্রোগ্রামিংয়ে।

পেশা

১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থায় (আইএইসি) সিস্টেম অ্যানালিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরে ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষকতাও করেছেন তিনি।

এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে তিনি গণিতশাস্ত্র ও কম্পিউটার বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের কম্পিউটার সার্ভিস ডিভিশনের ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বাংলাদেশ গণিত সমিতিরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি।

এমনিতে কম্পিউটার ও গণিত নিয়ে পড়াশোনা করলেও শিল্প–সাহিত্যসহ নানা বিষয়ে তাঁর ছিল অপরিসীম আগ্রহ। বাংলা–ইংরেজি ছাড়াও তিনি উর্দু, আরবি, হিন্দি, জার্মান ও রুশ ভাষা জানতেন।

সম্মাননা

মো. হানিফউদ্দিন মিয়াকে মরণোত্তর সম্মাননা জানিয়েছে আইসিটি বিভাগ ও বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি। ২০১৫ সালে আইসিটি ডিভিশন ও বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি যখন বাংলাদেশ আইসিটি এক্সপোর আয়োজন করে তখন ১৭ জুন ২০১৫ সম্মাননা দেয়া অনুষ্ঠানে স্ত্রী ফরিদা বেগম তার তৃতীয় প্রজন্ম- ছেলের ছেলে নাতি ইরফানকেও নিয়ে এলেন। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির ইতিহাসে এটি একটি মাইলফলক ঘটনা।

ইরফান সেদিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিলো, আমি জানতাম না আমার দাদা এতো বড় মাপের মানুষ ছিলেন। সত্যিকার অর্থে আমরাও জানতাম না তিনি কতো বড় মাপের মানুষ ছিলেন।

তাঁর স্মরণে বাংলাদেশ ডাক অধিদপ্তর একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রবর্তন করে। ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর ঢাকায় ডাক অধিদপ্তর মিলনায়তনে তাঁর স্মরণে ডাক অধিদপ্তরের স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত করা হয়। সে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তব্য দেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।

২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয়ে তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০১৬ সালে হুলহুলিয়াতে ডিজিটাল হাব প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার এটি উদ্বোধন করেন। এর সাথে হানিফ উদ্দিনের নিজের গ্রাম বিধায় হুলহুলিয়ায় এমন ডিজিটাল হাব তৈরি এবং তা উদ্বোধনে মন্ত্রীর আগমণ ঘটে। তাছাড়া, মোস্তফা জব্বার বিভিন্ন সময়ে এই কৃতি সন্তানের কথা গর্বের সাথে স্মরণ করেন অবলীলায়।

নাটোর জেলা সমিতির উপদেষ্টা

প্রয়াত ডঃ হনিফ উদ্দিন মিয়া, এ্যাটোমিক এনার্জির সাবেক চীফ সাইন্টিফিক অফিসার ও নাটোর জেলা সমিতির উপদেষ্টা যার স্নেহের ছাতার নীচে থেকে আ‌শির দশ‌কে নাটোর জেলা সমিতির কাজ করতে গিয়ে অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল।প্রয়াত ডঃ হনিফ উদ্দিন মিয়ার এই ছবিটি সে সময়ে নাটোর জেলা সমিতির মূখপত্র আমার সম্পাদিত নাটোর দর্পণে প্রকাশিত হয়েছিল।

আইবিএম ১৬২০ কম্পিউটার

বাংলাদেশ তখনো স্বাধীন হয়নি। কলম্বো প্ল্যানের আওতায় ১৯৬৪ সালের শেষ দিকে পাকিস্তানে প্রথম কম্পিউটার হিসেবে আসে দ্বিতীয় প্রজন্মের একটি মেইনফ্রেম কম্পিউটার, আইবিএম ১৬২০। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস মেশিনস করপোরেশন (IBM) এটা পাকিস্তান সরকারকে উপহার দিয়েছিল। কম্পিউটারটি পাকিস্তান পরমাণু শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের লাহোর অফিসে স্থাপন করতে চেয়েছিল তৎকালীন সরকার। কিন্তু এ রকম একটি জিনিস চালানোর মানুষ তো লাগবে। কে আছে এমন? শুরু হলো খোঁজ।

ব্রিটিশ একাডেমিক অ্যাডাম কার্লের হিসাব অনুযায়ী সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের সাক্ষরতার হার মাত্র ১৯ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০ শতাংশের কম মানুষ পঞ্চম শ্রেণি শেষ করেছে, এমন অবস্থা। কাজেই কম্পিউটার প্রোগ্রামার খোঁজার কাজে পূর্ব পাকিস্তানের কথা ভেবেও দেখতে চায়নি পাকিস্তান সরকার। কিন্তু দীর্ঘ সময় খোঁজাখুঁজির পরও যখন পশ্চিম পাকিস্তানে তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি, তখন বাধ্য হয়ে খোঁজ শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তানে। জানা গেল, এমন একজন আছেন। পাকিস্তান সরকার তাঁকে লাহোরে আমন্ত্রণ জানাল। দেশপ্রেমিক মানুষটি প্রত্যাখ্যান করলেন সরকারের আমন্ত্রণ। তাঁর এক কথা, পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে তিনি যাবেন না।

ফলে আইবিএম ১৬২০ চলে এল পূর্ব পাকিস্তানে, পরমাণু শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের ঢাকা অফিসে। কম্পিউটার সার্ভিস বিভাগের দায়িত্ব নিলেন দেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার মো. হানিফ উদ্দিন মিয়া। তারপর যত দিন এই পদে দায়িত্ব পালন করেছেন, তত দিন পুরো পাকিস্তানের সব বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি ও আধা সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করেছেন বিভিন্নভাবে। ঢাকা শহরের কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন জমির দূরত্ব এবং সে হিসাবে জায়গার দামের মধ্যকার সম্পর্ক খুঁজে বের করেছিলেন তিনি এর সাহায্যে। বলাই বাহুল্য, এসব তথ্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের কাজেও লেগেছে অনেক।

১৯৬৪ সালে ঢাকার পরমাণু শক্তি কমিশনে যে কম্পিউটারটি বসানো হয়, সেটি ছিল আইবিএম ১৬২০ মডেলের একটি মেইনফ্রেম কম্পিউটার। এর র‍্যাম ছিল মাত্র ২০ কিলোবাইট। পরে এই র‍্যামকে ৬৪ কিলোবাইটে আপগ্রেড করা হয়। দ্বিতীয় প্রজন্মের এ কম্পিউটারকে আনা হয়েছিল কলম্বো প্ল্যানের আওতায়। এ কম্পিউটার দিয়ে পুরো পাকিস্তানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও আধা সরকারি গবেষণাগারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে হিসাব-নিকাশ ও তথ্য সংরক্ষণের কাজ করা হয়েছে। ১৯৮০-এর দশকে এই কম্পিউটার থেকে টেলিফোন বোর্ড ইলেকট্রনিক বিল ব্যবহার শুরু করে।

১৯৮০ সালের ৫ জুলাই আইবিএম ১৬২০–কে পুরোপুরি অকার্যকর বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। ২০০১ সালে দেশে ব্যবহৃত প্রথম কম্পিউটারটিকে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়। এর এক বছর আগে ২০০০ সালে নিজ গ্রাম হুলহুলিয়া হাইস্কুলে দুটি আইবিএম ডেস্কটপ কম্পিউটার উপহার দেন তিনি। এরপর থেকেই এই গ্রাম থেকে বাড়তে থাকে কম্পিউটার প্রকৌশলীর সংখ্যা। ছোট্ট এই গ্রাম থেকে বেড়ে উঠেছেন শতাধিক প্রকৌশলী।

বর্তমানে এই কম্পিউটার জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের তথ্যপ্রযুক্তি গ্যালারিতে প্রদর্শনীর জন্য উন্মুক্ত আছে।

মৃত্যু

২০০৭ সালের ১১ মার্চ মারা যান দেশের এই কৃতী সন্তান। রেখে যান দেশের জন্য মাথা উঁচু করে কাজ করে যাওয়ার অনুপ্রেরণা। কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে। এই অগ্রযাত্রার ইতিহাসে নিঃসন্দেহে অমর হয়ে থাকবে হানিফ উদ্দিন মিয়া। বাংলাদেশের ডিজিটাল অগ্রযাত্রায় তার অবদান অনস্বীকার্য, আমরা জানি আর নাই জানি। তবে, এসব নায়কদের সম্পর্কে জানার প্রয়োজন আছে, তাদের স্মরণ ও সম্মান করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *