স্যার যদুনাথ সরকার

ভারতবর্ষে ইতিহাস রচনায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণার পথিকৃৎ স্যার যদুনাথ সরকার। নাটোরের প্রতিভাবান বিখ্যাত সন্তানদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তার প্রধান অবদান ছিল বাংলার ইতিহাসের উপর তার গবেষণা। তিনি বাংলার ইতিহাসে একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ হিসেবে বিবেচিত হন। তিনি বাংলার ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয়ে বহুমূল্য গ্রন্থ রচনা করেন। তার রচিত গবেষণাধর্মী গ্রন্থগুলি বাংলার ইতিহাসের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে।

বাল্যকাল

যদুনাথ সরকারের জন্ম ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর, বৃহত্তর রাজশাহী জেলার আত্রাই থানার (বর্তমান নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলার ছাতারদিঘী ইউনিয়ন) কড়চমারিয়া গ্রামে৷ পিতা রাজকুমার সরকার এবং মাতা হরিসুন্দরী দেবীর ৭ পুত্র এবং ৩ কন্যার মধ্যে তিনি ৫ম সন্তান, ৩য় পুত্র। তাদের পূর্বপুরুষ ধনাঢ্য জমিদার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। বিদ্যানুরাগী রাজকুমার সরকারের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার ছিল বিশালাকার। গণিতের ছাত্র হলেও ইতিহাসে ছিল গভীর আগ্রহ। নানা জনহিতকর কাজে তিনি সময় ও অর্থ ব্যয় করতে ভালোবাসতেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এই বিষয়াদি যদুনাথ সরকারকে প্রভাবান্বিত করেছিল। পিতার মাধ্যমেই অল্প বয়সে তাঁর পরিচয় হয়েছিল বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘হিস্ট্রি অব ইংল্যান্ড’ নামীয় গ্রন্থের সঙ্গে। রাজকুমার সরকার পুত্রের হাতে প্লুটার্ক রচিত প্রাচীন গ্রিক ও রোমান নায়কদের জীবনী তুলে দিয়েছিলেন। পিতাই তাঁর কিশোর চিত্তে ইতিহাসের নেশা জাগিয়ে দিয়েছিলেন ।

নাটোরের আরেক গুণী লেখক সমর চন্দ্র পাল মূলত বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া প্রত্নসম্পদ, নৃতত্ত্ব, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বিস্তৃত স্থান ও ব্যক্তিত্ব, লোক সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেছেন। তরণ প্রজন্মকে শেকড়-সন্ধানী হতে আগ্রহী করা এবং আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রকে প্রাগ্রসর করাই তাঁর লক্ষ্য।

শিক্ষাজীবন

গ্রামের স্কুলে তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু। তারপর অধ্যয়ন করেছেন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে। এরপর গন্তব্য কোলকাতার হেয়ার স্কুল ও সিটি কলেজিয়েট স্কুল। পরে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করেন প্রথম শ্রেণীতে ষষ্ঠ স্থান অর্জন করেন। তিনি রাজশাহী কলেজ থেকে ১ম বিভাগে দশম স্থান অধিকার করে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে। পরবর্তী গন্তব্য কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ। থাকতেন ইডেন হোস্টেলে।

১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইতিহাস ও ইংরেজি সাহিত্য – এই দুটি বিষয়ে অনার্সসহ বি.এ পাশ করেন এবং ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে ৯০% নম্বর নিয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ পাশ করেন৷ ১৮৯৭ সালে তিনি ‘প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ’ স্কলারশিপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্বর্ণপদকসহ দশ হাজার টাকা বৃত্তি লাভ করেন৷

কর্মজীবন

১৮৯৩ সালে যদুনাথ ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে কলকাতার রিপন কলেজে যোগদান করেন। ১৮৯৮ সালে তিনি প্রাদেশিক শিক্ষা বিভাগে যোগ দেন এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে নিয়োগ লাভ করেন। অধ্যাপনার মাধ্যমে ১৮৯৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে তার প্রথম কর্মস্থল নির্ধারিত হয়।তাঁর প্রবন্ধ India of Aurangzeb ১৯০১ সালে প্রকাশিত হয়।

১৮৯৯ সালে পাটনা কলেজে বদলী হয়ে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানে ছিলেন। মাঝখানে কিছুকাল ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে অধ্যাপনা করেন। ১৯১৭ সালে যদুনাথ বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে যোগদান করেন। ১৯১৮ সালে তিনি ভারতীয় শিক্ষা বিভাগের জন্য মনোনীত হন। ইংরেজি ও ইতিহাস দুটি বিষয়ই পড়াবার জন্য তাঁকে কটকের র‌্যাভন’শ কলেজে বদলি করা হয়।অধ্যাপক জীবনের বেশীরভাগ সময়ই কাটে পাটনা ও কটকে। ১

যদুনাথ সরকার ১৯২৩ সালে রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির সম্মানিত সদস্য হন।

৯২৬ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করার পর ৪ আগস্ট, ১৯২৬ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে মনোনীত হন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনিই প্রথম অধ্যাপক ভাইস-চ্যান্সেলর ছিলেন তিনি। ১৯২৮ সালের ৭ আগস্ট তাঁকে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।

সাহিত্যিক জীবন

ইতিহাস শাস্ত্রে অসাধারণ ও প্রগাঢ় জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন যদুনাথ সরকার। তাকে ইতিহাস-চর্চায় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন ভগিনী নিবেদিতা, যিনি সিস্টার নিবেদিতা নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি ঐতিহাসিক গবেষণা-গ্রন্থ রচনার জন্য বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত ভাষা ছাড়াও উর্দু, ফারসী, মারাঠীসহ আরও কয়েকটি ভাষা শিখেছিলেন।[৫]

ঐতিহাসিক গবেষণা ছাড়াও তিনি একজন বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ছিলেন। এছাড়াও, রবীন্দ্র-সাহিত্যের সমঝদার পাঠক ছিলেন যদুনাথ সরকার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার পাবার আগেই তিনি কবির রচনার ইংরেজি অনুবাদ করে পাশ্চাত্য জগতের কাছে তার পরিচয় তুলে ধরেন।

রচিত গ্রন্থসমূহ

যদুনাথ সরকার ২৫টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এছাড়াও, ১২টি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। ১৯০১ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গ্রন্থ পাঁচ খণ্ডে সমাপ্ত ‘হিস্ট্রি অব ঔরঙ্গজেব’। তার রচিত অন্যান্য গ্রন্থ হলো:

  • দ্য ফল অব দ্য মুঘল এম্পায়ার (মুঘল সাম্রাজ্যের পতন)
  • শিবাজী
  • মিলিটারী হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া (ভারতের সামরিক ইতিহাস)
  • দ্য রানি অব ঝাঁসী (ঝাঁসীর রানী)
  • ফেমাস ব্যাটেল্‌স্‌ অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি (ভারতীয় ইতিহাসের বিখ্যাত যুদ্ধ)
  • শিবাজী এন্ড হিজ টাইম (শিবাজী ও তার সময়)
  • ক্রোনোলজী অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি (ভারতীয় ইতিহাসের কালক্রম)

তার সংগৃহীত গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপি ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে।

রকমারিতে পাবেন যে বই সমূহ

  • এ শর্ট হিস্টরি অব আওরঙ্গজেব
  • মুঘল ভারত
  • শিবাজী
  • ইতিহাস ঐতিহাসিক ও ইতিহাসের উপাদান
  • মুঘল-ভারত
  • মধ্যযুগে বাংলা
  • The History of Bengal Volume 2
  • A Short History of Aurangzeb
  • The History of Bengal Volume 2 – Muslim Period: 1200 AD – 1757 AD
  • India After Independence

মতবাদ

যদুনাথের পিতা ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এ ধর্মমতের প্রতি যদুনাথের কতটা আকর্ষণ ছিল তা বলা মুশকিল। তিনি কৃষ্ণদাস কবিরাজের  চৈতন্য চরিতামৃত-এর (সতের শতকে) একটি সংক্ষিপ্ত ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। ব্রাহ্মরা কোনোদিনই যদুনাথকে তাঁদের সম্প্রদায়ভুক্ত বলে দাবি করেন নি।

বাঙালিরা কাপুরুষ- ইংরেজদের মধ্যে প্রচলিত এই মতবাদকে যারা খন্ডন করতে চেষ্টা করেছিলেন, যদুনাথ ছিলেন সেই সব জাতীয়তাবাদী বাঙালির সাহিত্যকর্মের বিরোধী। এর ফলে যদুনাথকে প্রায়শই ইংরেজ সমর্থক আখ্যা দেওয়া হতো। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘নাইট’ উপাধি দান করলে তাঁর সম্পর্কে এ ধারণা দৃঢ়তর হয়। তিনি মনে করতেন যে, ইংরেজদের কারণে ভারতের অগ্রগতি সাধিত হয়েছে এবং এ কারণে ইংরেজদের প্রতি তাঁর প্রশংসামূলক উক্তি এ ধারণাকে আরও দৃঢ় করে তুলেছিল।

যদুনাথের ঐতিহাসিক রচনাবলিকে প্রধানত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়।

প্রথম শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত তাঁর গুরুত্বপূর্ণ রচনাবলি History of Aurangzib (পাঁচ খন্ড, ১৯১২-১৯৫৮), Shivaji and His Times (১৯১৯), Mughal Administration (১৯২০), Later Mughals (সম্পাদিত, ১৯২২, ২ খন্ড), Fall of the Mughal Empire (৪ খন্ড, ১৯৩২-১৯৩৮), Military History of India (১৯৬০) ইত্যাদি।

দ্বিতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ফারসি ও মারাঠি দলিলপত্রের ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদসমগ্র এবং ইংরেজি ও বাংলায় অসংখ্য প্রবন্ধ, সমালোচনা এবং চিঠিপত্র। বাংলায় প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধের সংখ্যা ১৪৮টি, যা ইংরেজিতে প্রকাশিত ৩৬৫টি প্রবন্ধের চেয়ে সংখ্যায় অনেক কম। বাংলায় যেখানে তিনি মাত্র চারটি গ্রন্থ রচনা করেন সেখানে সম্পাদিত গ্রন্থাবলিসহ ইংরেজিতে তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা ৩১টি। যদুনাথের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণাকে যথাযথভাবে প্রকাশ করা দুঃসাধ্য, কারণ এ বিষয়ে তিনি কিছু লেখেন নি। ইংরেজি সাহিত্য পড়ার পর যদুনাথ কেন দিক পরিবর্তন করে মধ্যযুগের ইতিহাসে আগ্রহী হয়েছিলেন সেটা নিরূপণ করাও কঠিন।

উনিশ শতকের বাংলায় দুটি ঐতিহাসিক ধারণা মুখোমুখি হয়। একটি ছিল আঠারো শতকের শেষভাগ থেকে শুরু হওয়া ইংরেজ ঐতিহাসিকদের লেখা। দ্বিতীয় ধারণাটি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী লেখা যেগুলিতে প্রায়শ বাংলায় বীরের সৃষ্টি করা হতো এবং যদুনাথ প্রায়ই যার বিরোধিতা করে লিখতেন। তাঁর এ ধরনের লেখা, বিশেষত ‘মুক্তিযোদ্ধা’ প্রতাপাদিত্যের ঐতিহাসিকতার বিরুদ্ধে রচনা এ ধারণাকে দৃঢ় করে যে, যদুনাথ ইংরেজ সমর্থক ছিলেন।

ইলিয়ট ও ডাউসন যদুনাথকে প্রভাবিত করেছিলেন, তবে তাঁদের উভয়ের চিন্তাধারা এক ছিল না। নিজের প্রথম গ্রন্থে ইলিয়টের দাবির বিপক্ষে যদুনাথ দেখান যে, মুসলমান ঐতিহাসিকগণ শুধু রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কেই লেখেননি, তাঁরা মুগল সাম্রাজ্যের আর্থ-সামাজিক বিষয়েও লিখেছিলেন। সাধারণ অর্থে, যদুনাথ মিলের পথনির্দেশ গ্রহণ করেছিলেন। মুগলপূর্ব সুলতানি আমলকে যদুনাথ ‘অন্ধকার যুগ’ বলে বিবেচনা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে শিল্পকলা, শাসনপদ্ধতি ও আইন-শৃঙ্খলাকে  আকবর এক নতুন উন্নততর অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সব সময়ই জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক শ্রেণিরূপে তুলনা করায় মিল অথবা এলফিনস্টোন দুজনের কেউই সুলতানি আমলকে সেভাবে বিবেচনা করেন নি।

যদুনাথ আকবরের প্রশংসা করলেও তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রথম গ্রন্থের বিষয়বস্ত্ত হিসেবে আওরঙ্গজেবকে বেছে নিয়েছিলেন, যার ফলে তিনি প্রায় এলফিনস্টোনের পর্যায়ে পৌঁছে যান। যদুনাথ এলফিনস্টোন থেকে ভিন্নমত প্রকাশ করেন। আওরঙ্গজেবের নীতির প্রতিক্রিয়ার ফলে মুগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল এবং প্রগতিশীল ও সুসভ্য ইংরেজ কর্তৃক ভারতীয় সভ্যতা পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল এটা দেখানোই ছিল এলফিনস্টোনের উদ্দেশ্য। Fall of the Mughal Empire গ্রন্থের মাধ্যমে যদুনাথ দেখাতে চেয়েছিলেন যে, অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কারণেই মুগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল। তবে ইংরেজদের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি নীরব ছিলেন।  পলাশীর যুদ্ধএর বর্ণনার পরই শুধু তিনি ইংরেজদের বিজয়কে ‘নতুন রেনেসাঁর’ অগ্রদূত রূপে ঘোষণা করেছিলেন, ‘…পৃথিবী যার সমতুল্য আগে কোনোদিন দেখেনি…’।

জেমস মিল-এর ভারতীয় ইতিহাসের যুগ-বিভাজন সম্পর্কেও যদুনাথ তেমন উচ্চবাচ্চ করেন নি। এ ধরনের কাল-বিভাজনের জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক ভিত্তি সম্পর্কে তিনি নির্দিষ্টভাবে বিরোধিতা করেন নি, তবে অধিক্রমণকারী যুগগুলির সমস্যাবলি অনুধাবনের অসুবিধাগুলি তিনি আগেই বুঝেছিলেন। যদুনাথের পদ্ধতিগত বিদ্যার অন্যতম ছিল ‘সাক্ষ্য-প্রমাণের’ উপর গুরুত্ব আরোপ, যদিও তিনি সেসব সাক্ষ্যের সমর্থনের বিবরণে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করেন নি। ‘সত্য’ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বিভিন্ন ভাষার দলিলপত্র সংগ্রহে অনেক পরিশ্রম করেন। সেই সময়ের পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাঁর পূর্বসূরিদের অনেকের মতোই যদুনাথ প্রধানত রাজনৈতিক ও সামরিক প্রকৃতির ‘সত্য’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অনুসন্ধানের ফলে জয়পুর থেকে প্রাপ্ত আখবরাত,  বাহারিস্তান-ই-গায়েবী, হাফ্ত আঞ্জুমান ও অন্যান্য দলিলপত্রসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র আবিষ্কৃত হয়েছিল। এগুলির বেশ কয়েকটি ততোদিন পর্যন্ত ব্যক্তিগত সংগ্রহে অথবা ইউরোপীয় মহাফেজ খানায় রক্ষিত ছিল। বস্ত্তত, যদুনাথ তাঁর সারাজীবন এ ধরনের দলিলপত্র সংগ্রহেই ব্যয় করেছেন, যেগুলি তিনি প্রায়ই ‘ইন্ডিয়ান হিস্টোরিক্যাল রেকর্ডস কমিশন’-এর সম্মেলনে উপস্থাপন করেছিলেন। সমকালীন ইংরেজি ও ফরাসি দলিলপত্রকে তিনি প্রায় একই রকম গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সতের শতকের ফরাসি বণিক ফ্রাঁসোয়া মার্টিনের রোজনামচার অংশবিশেষ তিনি উদ্ধার করেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ সেন অবশ্য তাঁর অনুবাদ কর্মের কঠোর সমালোচনা করেন। অন্যদিকে যদুনাথ সংস্কৃত কাব্য, মারাঠা দলিলপত্র এবং বখর সাহিত্যের মূল্য সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন। যদুনাথের কাছে পুণা রেসিডেন্সির পত্রাবলির মতো সমকালীন ইংরেজি পত্রাবলি ছিল অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভারতীয় দলিলপত্রে না পাওয়া অনেক তথ্য সেখান থেকে জানা গিয়েছিল।

ইউরোপীয় এই সব দলিলপত্র যদুনাথের ‘সত্য’ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়েছিল। যুদ্ধ সম্পর্কিত তাঁর গ্রন্থে সৈন্য চালনার বর্ণনা দিতে এবং যথাযথ স্থান চিহ্নিত করতে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন এবং এ উদ্দেশ্যে তিনি স্থানগুলি বারবার পরিদর্শন করেন। ফলে যুদ্ধগুলির বর্ণনা অনেক বেশি জীবন্ত হয়ে ওঠে। এসব ক্ষেত্রে যদুনাথ তাঁর ভৌগোলিক জ্ঞান ব্যবহার করেছেন, যা সমকালীন অন্যান্য ঐতিহাসিক করেন নি। তাঁর পূর্বকৃত শনাক্তীকরণ তিনি বহুবার শুদ্ধ করেছেন। সুতরাং যদুনাথ প্রায় নৈর্ব্যক্তিকভাবে ‘ঘটনাবলির’, অবশ্য দলিলপত্রে শুধু তাঁর দৃষ্টিগোচর ‘ঘটনাবলির’, মধ্যে ‘সত্য’ সন্ধান করেছিলেন।

যদুনাথ তাঁর গ্রন্থাবলির জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। এর কতগুলি তিনি পরবর্তীকালে আবার সম্পাদনা করেছিলেন। তাঁর আওরঙ্গজেব এবং শিবাজি গ্রন্থ দুটিতে দুজন ব্যক্তিকে ঘিরে সতের শতকের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে, যদিও তাঁর Later Mughals এবং Fall of the Mughal Empire গ্রন্থ দুটিতে আঠারো শতকের ব্যক্তিবর্গ ও ঘটনাবলি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আওরঙ্গজেব গ্রন্থে মুগল সাম্রাজ্যের পতনের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে এবং এর বিপরীতে শিবাজি গ্রন্থে এক বীরোচিত নেতার নেতৃত্বে একটি জাতির অভ্যুদয় চিত্রিত হয়েছে। যদুনাথের কাছে ব্যক্তিগত নেতৃত্বই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তবে বাস্তবে এদুটি গ্রন্থ ছিল একটি সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের ও অপর একটির উত্থানের কাহিনী, যেখানে রাষ্ট্র ছিল মূল বিষয়।

অন্যান্য গ্রন্থেও মুগল ও মারাঠা, উভয়ের অবক্ষয় এবং ইংরেজদের উত্থানের প্রায় একই চিত্র পাওয়া যায়। বিরুদ্ধপক্ষীয় শক্তিগুলির পটভূমিতে দেশ এবং রাষ্ট্র ছিল যদুনাথের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সঠিকভাবে বলতে গেলে যদুনাথ শুধু মুগলদের অবক্ষয় সম্পর্কে আলোচনা করেছেন এবং তিনি মারাঠাদের অবক্ষয়ের বা ইংরেজদের অভ্যুত্থানের বিস্তারিত বর্ণনা দেন নি। তাদেরকে সব সময়ই পশ্চাদাসীন করে রাখার ফলে তাদের সম্প্রসারণের প্রচেষ্টাকে অবহেলা করা হয়েছে। এটা যথেষ্ট স্পষ্ট হয়ে উঠে ১৭৫৭ সালে বাংলার নওয়াব  সিরাজউদ্দৌলার পতনের ওপর তাঁর বিবরণে। সেখানে নিজামতের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং নওয়াবের ‘পাপিষ্ঠ চরিত্র’ বিস্তারিতভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় লিখিত পরবর্তীকালের ফারসি উৎসগুলির ভিত্তিতে যদুনাথ এ ধরনের বিশ্লেষণকে সমর্থন করেছেন।

যদুনাথ ভিনসেন্ট স্মিথের ইতিহাসের ধারণা, অতীত থেকে জ্ঞানলাভ, ইতিহাসের বাস্তবধর্মী পরিকল্পনার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু স্পষ্টতই মিলের কাছ থেকে নেওয়া সভ্যতার অগ্রগতির ধারণা ছিল তাঁর কাছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। ১৯২৮ ও ১৯৩২ সালের মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে প্রগতিবাদী ধারণার প্রতি তাঁর এই পরিবর্তন এসেছিল। সেই সময় নাগাদ যদুনাথ ভারতীয় জাতীয়তার বিকাশ সম্পর্কে সচেতন হয়ে পড়েছিলেন। আকবরের বিপরীতে আওরঙ্গজেব তাঁর মৌল ধারণাদ্বারা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিলেন, যা ভারতীয় জাতীয়তার বিকাশকে ধ্বংস করেছিল- এই ছিল এলফিনস্টোনের প্রায় সদৃশ যদুনাথের মূলভাব। পরবর্তীকালের এম আতাহার আলী (Mughal Nobility Under Aurangzeb, 1966) এবং ইরফান হাবিবের (Agrarian System of Mughal Empire, 1963) গবেষণা থেকে দেখা যায় যে এলফিনস্টোনের ধারণা, যা যদুনাথ গ্রহণ করেছিলেন, ঐতিহাসিকভাবে যথার্থ ছিল না এবং মুগল সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের জন্য মূলত প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কারণ দায়ী ছিল। সুতরাং যদুনাথ নৈতিক অধঃপতন এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারণে এ সংকটের সৃষ্টি বলে যেভাবে এটাকে দেখেছেন, সে তত্ত্ব টেকে না।

যদুনাথের শিবাজি-র ওপর উনিশ ও বিশ শতকের মারাঠা জাতীয়তাবাদের কোন প্রভাব ছিল না। কেননা পূর্বেই দেখা গেছে, অনৈতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে লেখার জন্য তিনি জাতীয়তাবাদীদের বিপক্ষে ছিলেন। তবুও অধিকতর মনোযোগ দিয়ে শিবাজি পড়লে এ ধারণা পাওয়া যায় যে, যদুনাথ মারাঠা জাতীয়তাবাদ থেকে পুরোপুরি মুক্ত ছিলেন না। তবে যদুনাথের দৃষ্টিতে বাজী রাওয়ের মৃত্যুর পর মারাঠা আন্দোলনে পরিবর্তন সূচিত হয়। এসময় গোড়া হিন্দুধর্ম প্রাধান্য লাভ করে, আর শিবাজীর প্রশাসনিক কাঠামোতেই সরকার তা প্রত্যক্ষ করেন। একই সাথে তিনি শিবাজি সম্পর্কিত কাল্পনিক কাহিনীর বিরুদ্ধেও কঠোর ভাষায় লিখেছিলেন।

History of Aurangzib-এর পঞ্চম খন্ডের ১৯৫১ সালের সংস্করণে যদুনাথ ‘Aurangzib and the Indian’ শীর্ষক একটি অধ্যায় সংযোজন করেন। সেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন যে, মুসলমানরা প্রগতিশীল হলেও হিন্দুরা ছিল তাদের কর্তৃত্বাধীন। নিপীড়িত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারে নি। শেষ পর্যন্ত মুসলমানরা ভারতের বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তাদের পতন ডেকে আনে এবং বর্ণপ্রথা ও তাদের সংঘাত হিন্দুদের পতন ঘটায়। সে সময় ইউরোপীয়রা প্রযুক্তিগত জ্ঞান আহরণে ও প্রয়োগে এগিয়ে যাচ্ছিল, যার ফলে তারা এশিয়া ও আফ্রিকার ওপর প্রভুত্ব স্থাপন করে।

সাধারণ অর্থে এই হচ্ছে মিলের মনশ্চক্ষে দেখা সভ্যতার প্রগতির ধারণা। প্রতিটি বিজয়ই ছিল এই প্রগতির দৃঢ়োক্তি। সেই একই প্রমাণে সুলতানি আমলকেও সেভাবে দেখা উচিৎ ছিল। কিন্তু যদুনাথ এ আমলকে একটি ‘অন্ধকার যুগ’ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করেছেন। তরফদার যথার্থই প্রশ্ন তুলেছেন যে, পূর্ববর্তী যুগ এত অন্ধকারাচ্ছন্ন হলে আকবরের আমল সভ্যতার আলোক-সঙ্কেত হয়েছিল কেমন করে। আধুনিক গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, আকবর মাত্র দুটি রাজপুত পরিবারের প্রতি তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন এবং তাঁর দুজন উত্তরাধিকারী জাহাঙ্গীর এবং শাহজাহান সে পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্র প্রসারিত করেছিলেন। বাস্তবে আকবরের আমলের তুলনায় আওরঙ্গজেবের আমলে হিন্দু মনসবদারদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল, যা যদুনাথের তত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণিত করে। বৈষ্ণবদের বৃন্দাবন মঠসহ অন্যান্য অমুসলিম ধর্মাধিষ্ঠানে আওরঙ্গজেব যে প্রচুর দান করেছিলেন তা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে প্রমাণিত হয়েছে।

তা সত্ত্বেও যদুনাথ যে মধ্যযুগীয় ভারতে একটি বহুজাতিক সমাজে বিশ্বাস করতেন তা যে কেউ অনুধাবন করতে পারবেন। মুসলমান সুফীসহ বাইরে থেকে আগত নানা ধরনের প্রভাবে এই সমাজ গড়ে উঠেছিল। কিন্তু যদুনাথের মতানুসারে এই ‘মিশ্র সংস্কৃতি’ ছিল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। নিম্ন শ্রেণির ও নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে আদান-প্রদান ঘটেছিল নিচের স্তরে। যদুনাথ বিশ্বাস করতেন যে, ক্রমবর্ধমান ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে উন্নতি ঘটবে, তবে তিনি এটা সুনির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ করেন নি।

তাঁর মধ্যযুগের History of Bengal -এর (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৪৮, ২য় খন্ড) সংস্করণ থেকে মনে হয় যে, যদুনাথ বিশ্বাস করতেন যে বিস্মরণ ও অন্ধকার থেকে ইংরেজরা বাঙালিদের উদ্ধার করেছিল। এটা ছিল ‘বিপরীত চরিত্রের জাতীয়তাবাদ’, যা ইংরেজদের উপনিবেশিক নীতির প্রতি লক্ষ্য রাখে নি। ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে তিনি ছিলেন নীরব এবং এক অর্থে ইংরেজ ঐতিহাসিকদের সঙ্গে তাঁর খুব বেশি পার্থক্য ছিল না। পলাশীর যুদ্ধের অল্পকাল পরই যে ইংরেজদের উপনিবেশিক নীতির যাত্রা শুরু হয়েছিল সেটা তিনি কৌশলে এড়িয়ে গেছেন।

যদুনাথ অসাধারণ দক্ষতা ও সুন্দর রচনা ভঙ্গিতে ঘটনাবলি বর্ণনা করেছেন। তিনি মুগল সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও পতনের কাঠামো দিয়েছেন যা কিছুটা সংশোধনের পরও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। অবক্ষয়ের পটভূমিতে গ্রিক বিয়োগান্ত নাটকের চরিত্রের মতো ব্যক্তিগত সংঘাত, কাপুরুষতা, বীরত্ব ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে চূড়ান্ত নিয়তির দিকে ধাবমান বিশিষ্ট মুগল ও মারাঠা নায়কদের যে চিত্র অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে যদুনাথ সৃষ্টি করেছেন, তা আজ পর্যন্ত অনতিক্রান্ত রয়ে গেছে। ১৯৫৮ সালের ১৯ মে তাঁর মৃত্যু হয়। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও যদুনাথ

ঐতিহাসিক গবেষণা ছাড়াও তিনি একজন বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ছিলেন। এছাড়াও, রবীন্দ্র-সাহিত্যের সমঝদার পাঠক ছিলেন যদুনাথ সরকার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার পাবার আগেই তিনি কবির রচনার ইংরেজী অনুবাদ করে পাশ্চাত্য জগতের কাছে তাঁর পরিচয় তুলে ধরেন। 

জাভা-যাত্রার পূর্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্সটিটিউটে বৃহত্তর ভারত পরিষদের উদ্যোগে পরিষদের স্থায়ী সভাপতি রবীন্দ্রনাথকে ১৯২৭ সালের জুলাই মাসে বিদায় সম্ভাষণের অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য যদুনাথ সরকার সভাপতির অাসন অলঙ্কৃত করেন। সভাপতির ভাষণে তিনি রবীন্দ্রনাথকে “পূর্বতন ঋষিদের স্থলাভিষিক্ত অধুনাজীবিত ব্যক্তি” বলে অভিহিত করেন।

বিশ্বভারতীর শিক্ষাপদ্ধতি যদুনাথ সরকার অনুমোদন করেন নি। তিনি বিশ্বাস করতেন, উপযুক্ত যোগ্যতা সৃষ্টি, সুনির্দিষ্ট নিয়মে অধ্যয়ন এবং গবেষণার ক্ষেত্রে কঠোর অধ্যাবসায় দ্বারা নির্দিষ্ট ফল লাভ করাই শ্রেয়। তিনি মনে করতেন বিশ্বভারতীতে নীতিনিয়মের কঠোরতা নেই। কেবল আদর্শ ও ভাবের পরিবেশই এখানে রচিত হয়েছে। পূর্বতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে শিশু ও কিশোরদের পক্ষে এটা উপযোগী হতে পারে, কিন্তু বিশ্বভারতীর উচ্চতর বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে এটি উপযোগী নয়। এই পাঠপদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। পাঠক্রমে অধ্যয়ন করার জন্য অনুমোাদিত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া আবশ্যক ছিল না। শিক্ষার্থীরা আশ্রম বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেই বিশ্বভারতীতে প্রবেশাধিকার পেত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রস্তুতি ব্যতিরেকেই উচ্চতর পাঠক্রমে প্রবেশাধিকারকে যদুনাথ সন্তুষ্টিচিত্তে গ্রহণ করতে পারেননি।

১৯০৪ সাল থেকে মারাঠা ইতিহাস গবেষণা সূত্রে গোবিন্দ সখারাম সরদেশাইয়ের সঙ্গে যদুনাথের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব জন্মে। ওই সময় থেকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যদুনাথের পরিচয়। অনুমান করা হয় যদুনাথের পরামর্শে সরদেশাই তাঁর পুত্র শ্যামকান্তকে শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করতে পাঠান। বিশ্বভারতীর শিক্ষাক্রম সম্পর্কে যদুনাথ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেন নি। রবীন্দ্রনাথের পক্ষে যদুনাথের এই মনোভাব সহজভাবে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। যদুনাথ অবশ্য রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সহজভাবেই ঘনিষ্ঠতা রক্ষা করেন। তিনি দার্জিলিং-এ তাঁর টোঙ্গা রোডের বাড়ি থেকে প্রায়ই রবীন্দ্রনাথের জন্য টাটকা ছানা ও ছানার মিষ্টি রবীন্দ্রনাথের দার্জিলিং-এর বাসায় পাঠাতেন।

ইতিহাসবিদ স্যার যদুনাথ বিস্মৃত, জন্মভিটা বেহাত

ভারতবর্ষে ইতিহাস রচনায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণার পথিকৃৎ স্যার যদুনাথ সরকার। ইতিহাসবিদ হিসেবে বিশ্বে সমাদৃত হলেও নিজ পৈতৃকভিটায় তার কদর নেই। বেহাত হয়ে গেছে তাদের জমিদারবাড়ি। ওই বাড়িতে গড়ে উঠেছে ইউপি কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিক, সংঘ ও মাদ্রাসা। এদিকে স্যার যদুনাথ সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কোনো ধারণা নেই। স্থানীয় ইতিহাস জানানোর তাগিদ থেকেও স্কুল-কলেজে পালন করা হয় না তার জন্ম-মৃত্যু দিবস। অনেক শিক্ষকই জানেন না তার নাম।

এদিকে, ভূমিকম্পে তার রাজশাহীর বাড়ির ছাদের একাংশ ভেঙে পড়েছে। বাড়িটি রাজশাহী নগরের রানীবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, স্যার যদুনাথ সরকারের পরিত্যক্ত বাড়িতে ১৯৮০ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু করা হয়। দুই বছর পর থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও চালু করা হয়। দোতলা বাড়িতে একই সঙ্গে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়া হতো। কয়েক বছর ধরে বাড়ির দোতলা অংশটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ায় সেখানে আর ক্লাস নেওয়া হয় না। এখন সকালে প্রাথমিক ও সকাল ১০টার পর থেকে মাধ্যমিক শ্রেণির ক্লাস নেওয়া হয়।
২০১৫ সালে ভূমিকম্পের সময় ছাদের একটি জায়গা, রেলিং ও একটি পিলারের মাথা ভেঙে পড়ে। বহুবার সংস্কারের জন্য আবেদন করেও কোনো কাজ হয়নি। ভবনটি অর্পিত সম্পত্তি।

পুরস্কার ও সম্মাননা

যদুনাথ সরকার তার প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে বিরল সম্মাননা অর্জন করেছিলেন।

  • ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার তাকে নাইট উপাধি প্রদান করেন।
  • ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯৪৪ সালে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় ডি.লিট উপাধি প্রদান করে।
  • ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণায় যদুনাথ সরকার পথিকৃৎ বা পথ প্রদর্শক ছিলেন। এই কারণে দেশবাসী তাকে আচার্য হিসাবে বরণ করেছিলেন

মৃত্যু

আচার্য যদুনাথ সরকার ৮৮ বৎসর বয়সে ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মে তারিখে কলকাতায় পরলোকগমন করেন।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *