মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়

নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ ছিলেন সুসাহিত্যিক, স্বদেশপ্রেমিক, সমাজসেবক, সঙ্গীতজ্ঞ, বিদ্যোৎসাহী, গুণগ্রাহী, বলিষ্ঠ বক্তা এবং বিশিষ্ট ক্রীড়া-ব্যক্তিত্ব। শরীরচর্চা ও খেলাধুলায় তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ বাড়াতে তাঁর অসামান্য অবদান ছিল। বাংলার ক্রিকেট জগতের পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে তিনি একজন প্রাণপুরুষ।

বাল্যকাল

নাটোর শহরের হরিশপুরে ১৮৬৮ সালের ২০ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন জগদিন্দ্রনাথ। তাঁর আসল নাম ব্রজনাথ। বাবার নাম শ্রীনাথ রায় এবং মায়ের নাম প্রসন্নময়ী দেবী।

১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে নাটোরের বড়তরফের মহারাজ গোবিন্দনাথের স্ত্রী মহারাণী ব্রজসুন্দরী তাঁকে দত্তক নেন এবং নতুনভাবে জগদিন্দ্রনাথ নাম রাখেন। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে সেখান থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অতঃপর কলেজে কয়েক বছর লেখাপড়া করেন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে জগদিন্দ্রনাথ কলকাতায় বসবাস শুরু করেন।

বৃহত্তর বঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জমিদার রানি ভবানীর পরবর্তী বংশধর মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় (১৮৬৮–১৯২৬) থাকতেন নাটোর শহরে। পড়াশোনার জন্য ১৮৭৯ সালে ১১ বছর বয়সে তিনি রাজশাহী শহরে আসেন, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষায়তন কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন পঞ্চম শ্রেণিতে।

বিবাহ

১৮৮৫ সালে মাতা মহারাণী ব্রজসুন্দরী দেবী তাঁর বিবাহ দেন শ্যামমোহিনী দেবীর সঙ্গে। তখন তার বয়স মাত্র ১৭ বছর। তাঁদের প্রথম দুই সন্তান,  প্রথমে  পুত্র  ও  দ্বিতীয়া  কন্যা, নাটোরে থাকাকালীন জন্মের পরে শৈশবেই মারা যায়। তাই জগদিন্দ্রনাথ চিকিত্সকদের পরামর্শ  অনুযায়ী তাঁর পরিবারকে নিয়ে কলকাতায় এসে প্রথমে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে  ও পরে ৬নং  ল্যান্সডাউন  রোডে (অধুনা শরৎ বোস রোড) বাসা ভাড়া করে  থাকতে  শুরু  করেন।  কিছুকাল  পরে  তিনি  সেই  বাড়ীটিই  আশি  হাজার  টাকায়  কিনে  নেন।

কলকাতাতেই তাঁর কন্যা  রাজকুমারী বিভাবতী  এবং পুত্র রাজকুমার যোগীন্দ্রনাথের জন্ম হয়। রাজকুমারী বিভাবতীর  বিবাহ  হয়  কলকাতা  হাইকোর্টের উকিল, যতীন্দ্রনাথ লাহিড়ীর সঙ্গে ১৯০৫ সালে। রাজকুমার যোগীন্দ্রনাথ তাঁর পিতার  মতই  সাংস্কৃতিবান  ব্যক্তি  ছিলেন।

খেলাধুলা, সঙ্গীত ও সাহিত্য

ধনী জমিদার হয়েও সমাজের আদর্শস্থানীয় হয়েছিলেন কবি মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়। এত বড় বহুমুখী প্রতিভা সচরাচর দেখা যায় না। খেলাধুলা, সঙ্গীত ও সাহিত্যের জগতে তিনি নিজের সাক্ষর রেখে গিয়েছেন।তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম “রজনীগন্ধা”।  পিতার  মৃত্যুর  পরে  মহারাজ যোগীন্দ্রনাথ রায় “মানসী ও মর্ম্মবাণী” পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের সহযোগিতায়।

১৮৮৬ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হন তিনি। রাজশাহীতে পড়ালেখা করার সময় পাঁচআনি মাঠে অনুষ্ঠিত ব্রিটিশ সাহেবদের ফুটবল, হকি, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলা দেখতেন জগদিন্দ্রনাথ। তখনো বর্তমান রাজশাহী কলেজের সুন্দর সবুজ মাঠটি তৈরি হয়নি। সেখানে ছিল জাদুকুণ্ড নামে একটি বড় দিঘি—১৯২৯-৩০ সালে এটি ভরাট করে মাঠ নির্মাণ করা হয়। ছাত্রজীবনে রাজশাহীতে ক্রিকেট খেলা দেখে এই খেলার প্রতি মনেপ্রাণে আকৃষ্ট হন জগদিন্দ্রনাথ। তবে কেবল আকৃষ্ট হয়েই থেমে থাকেননি, ক্রিকেটকে ঘিরে তাঁর মূল কর্মকাণ্ডই শুরু হলো কলকাতায়।

জগদিন্দ্রনাথ ১৮৮৯ সালের ৯ই অক্টোবর রাজকার্যভার গ্রহণ করেন। বৃটিশ ভারতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে প্রগতিবাদী চেতনার ক্ষেত্রে তার অবদান ছিল।

১৮৯৩ সালে পারিবারিক সিদ্ধান্তে স্থায়ীভাবে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন জগদিন্দ্রনাথ। প্রথম দিকে কলকাতার ৪ নম্বর ক্রিক রোডে বসবাস শুরু করলেও পরে ৫০ নম্বর পার্ক স্ট্রিট, ৩৫ নম্বর ওয়েলিংটন স্ট্রিট এবং সব শেষে ১৮৯৬ সালে ল্যান্সডাউন রোডে বাড়ি কিনে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেন। ১৮৯৯–তে কলকাতার বালিগঞ্জের বুন্দেল রোডে ৪৫ বিঘা বাগানবাড়ি কিনলেন তিনি। এর নামকরণ করলেন ‘নাটোর পার্ক’ নামে। সেখানে একটি ক্রিকেট মাঠ ও বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন নাটোরের এই মহারাজা।

জগদিন্দ্রনাথ সপরিবার কলকাতার বাসিন্দা হওয়ার পর কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলার মসুয়া গ্রামের বিখ্যাত রায় পরিবারের সদস্য সারদারঞ্জন রায়ের (১৮৫৮–১৯২৫) সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। সারদারঞ্জন রায় ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভাই। উপেন্দ্রকিশোরের নাম ছিল কামদারঞ্জন।

রাজনীতি

ধনী জমিদার হয়েও জগদিন্দ্রনাথ রাজনীতিতে নির্ভয়ে আত্মপ্রকাশ করে ভূমধ্যধিকারী সমাজের আদর্শস্থানীয় হন। ১৯০১ সালে কলকাতায় তিনি কংগ্রেসের অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ভারতের জাতীয় রাজনৈতিক বিষয় ও শিল্পের ওপর উল্লেখযোগ্য বক্তব্য রাখেন।১৯১৩ সালে তিনি বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

মৃত্যু

২৬ ডিসেম্বর ১৯২৫ তারিখে গড়ের মাঠের কাছে হাঁটতে গিয়ে একটি গাড়ির ধাক্কায় তিনি আশঙ্কাজনকভাবে আহত হন। ১০ দিন হাস্পাতালে চিকিত্সাধীন থাকার পর ৫ই জানুয়ারী ২০২৬ তারিখে তিনি পরলোক গমন করেন। তাঁর অকাল মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ,  মহাত্মা গান্ধী,  লর্ড লিট্টন প্রমুখরা শোক-সন্দেশ পাঠিয়েছিলেন।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *