নাটোর ইলেভেন-বাংলায় ক্রিকেটের অগ্রপথিক মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ

রাজকীয় খেলা ক্রিকেট ইংল্যান্ড থেকে ধীরলয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল তার উপনিবেশগুলোয়। এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা ছিল ব্রিটিশ ব্যবসায়ী, সিভিলিয়ান ও সামরিক বিভাগ–সংশ্লিষ্ট মানুষদের। শুরুতে খেলাটি সীমাবদ্ধ ছিল কেবল অভিজাত শ্রেণির মধ্যে। যে কারণে একে বলা হতো ‘গেম অব লর্ড’। তবে দিন দিন সেই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে।

বাংলায় ক্রিকেটের আগমণ ও আলোড়ন নিয়ে সমর চন্দ্র পালের বিভিন্ন লেখার সূত্রে বাংলায় ক্রিকেটের অগ্রপথিক নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়কে তুলে ধরতে আজকের এই লেখা।

ভারতে ক্রিকেট

পশ্চিম ভারতের পার্সি সম্প্রদায় উপমহাদেশে ক্রিকেট খেলা প্রবর্তন করে। তাদের উদ্যোগে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় Oriental Cricket Club. ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন রাজধানী কলকাতায় ক্রিকেটের মান উন্নয়নে প্রচেষ্টা চালায় ইংরেজরা। তবে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় ক্রিকেট নিয়ে।

১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে বোম্বেতে পার্সি ও ইংরেজদের মধ্যে প্রথম ম্যাচ খেলা হয়েছিল। ক্রিকেটে পার্সিদের মান এত উন্নত ছিল যে তারা পরবর্তী সময়ে ১৮৮৬ ও ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে খেলতে যায়। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু , পার্সি ও ইংরেজদের মধ্যে ত্রিদলীয় বা Triangular ক্রিকেট খেলা শুরু হয়। ১৯১২ থেকে মুসলিম টিম যুক্ত হলে চারদলীয় বা Quadrangular প্রতিযোগিতার সূত্রপাত ঘটে। ব্রিটিশ আমলে ক্রিকেট নিয়ে এ দেশের রাজা-মহারাজাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল বেশ আকর্ষণীয়ভাবেই। বাঙালিদের মধ্যে ক্রিকেট খেলাকে জনপ্রিয় করে তোলেন কোচবিহারের মহারাজ স্যার নৃপেন্দ্র নারায়ণ ভূপ বাহাদুর এবং নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়

বাংলায় ক্রিকেট ও মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ

বৃহত্তর বঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জমিদার রানি ভবানীর পরবর্তী বংশধর মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় (১৮৬৮–১৯২৬) থাকতেন নাটোর শহরে। পড়াশোনার জন্য ১৮৭৯ সালে ১১ বছর বয়সে তিনি রাজশাহী শহরে আসেন, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষায়তন কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন পঞ্চম শ্রেণিতে। ১৮৮৬ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হন তিনি। রাজশাহীতে পড়ালেখা করার সময় পাঁচআনি মাঠে অনুষ্ঠিত ব্রিটিশ সাহেবদের ফুটবল, হকি, ক্রিকেট ইত্যাদি খেলা দেখতেন জগদিন্দ্রনাথ। তখনো বর্তমান রাজশাহী কলেজের সুন্দর সবুজ মাঠটি তৈরি হয়নি। সেখানে ছিল জাদুকুণ্ড নামে একটি বড় দিঘি—১৯২৯-৩০ সালে এটি ভরাট করে মাঠ নির্মাণ করা হয়। ছাত্রজীবনে রাজশাহীতে ক্রিকেট খেলা দেখে এই খেলার প্রতি মনেপ্রাণে আকৃষ্ট হন জগদিন্দ্রনাথ। তবে কেবল আকৃষ্ট হয়েই থেমে থাকেননি, ক্রিকেটকে ঘিরে তাঁর মূল কর্মকাণ্ডই শুরু হলো কলকাতায়।

নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ ছিলেন সুসাহিত্যিক, স্বদেশপ্রেমিক, সমাজসেবক, সঙ্গীতজ্ঞ, বিদ্যোৎসাহী, গুণগ্রাহী, বলিষ্ঠ বক্তা এবং বিশিষ্ট ক্রীড়া-ব্যক্তিত্ব। শরীরচর্চা ও খেলাধুলায় তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ বাড়াতে তাঁর অসামান্য অবদান ছিল। বাংলার ক্রিকেট জগতের পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে তিনি একজন প্রাণপুরুষ। ক্রিকেট-প্রেমিক জগদিন্দ্রনাথ সম্পর্কে একালে আমরা খুব কমই জানি। ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে সেখান থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অতঃপর কলেজে কয়েক বছর লেখাপড়া করেন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে জগদিন্দ্রনাথ কলকাতায় বসবাস শুরু করেন।

জগদিন্দ্রনাথ সপরিবার কলকাতার বাসিন্দা হওয়ার পর কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলার মসুয়া গ্রামের বিখ্যাত রায় পরিবারের সদস্য সারদারঞ্জন রায়ের (১৮৫৮–১৯২৫) সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। সারদারঞ্জন রায় ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভাই। বলাবাহুল্য, উপেন্দ্রকিশোরের নাম ছিল কামদারঞ্জন।

১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে কলকাতা টাউন ক্লাব ক্রিকেট খেলার জন্য বিখ্যাত ছিল। ঐ সময় সে ক্লাবে খেলতেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর (১৮৬৩-১৯১৫ খ্রি .) ভাই মুক্তিদারঞ্জন ও কুলদারঞ্জন (১৮৭৮-১৯৫০ খ্রি . )। এরা ছাড়াও টাউন ক্লাবের সদস্য ছিলেন তাঁদের বড়ভাই অধ্যাপক সারদারঞ্জন (১৮৫৮ – ১৯২৫ খ্রিঃ)। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলার মসুয়া গ্রামের এই তিন ভাই বাংলার ক্রিকেটকে উজ্জ্বলতর অবস্থানে নিয়ে গেছেন।

ক্লাব

কলকাতাবাসী হবার পর মহারাজ জগদিন্দ্রনাথ কলকাতা ক্লাবের সদস্য, প্রেসিডেন্ট এবং পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করেছেন কয়েক বছর। কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজের (মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন ) অধ্যাপক (১৯০৯ থেকে অধ্যক্ষ) সারদারঞ্জন রায়কে বলা হতো বাংলার ক্রিকেটের জনক। টাউন ক্লাব তথা বাংলার ক্রিকেটের উন্নতির জন্য জগদিন্দ্রনাথ ও সারদারঞ্জন একজন অলরাউন্ডার পেশাদার ক্রিকেটারকে কোচ হিসেবে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। এছাড়াও তিনি ক্রিকেটার মেহতাকে পাঠিয়ে দিতেন খেলার মাঠে যাতে তরুণ ক্রিকেটাররা পারদর্শী হয়ে গড়ে উঠতে পারে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কলকাতার ক্রিকেটে পূর্ববাংলার সন্তানদের অবদান ছিল বিস্ময়কর এবং বলিষ্ঠ। ১৯৩৮-৩৯ খ্রিস্টাব্দের রঞ্জি ট্রফি জয়লাভকারী বাংলার ক্রিকেট দলের সদস্য কার্তিক বসু (১৯০৬-১৯৮৪ খ্রি .) কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি গ্রামের বিখ্যাত হেমেন্দ্রমোহন বসুর (১৮৬৬-১৯১৬ খ্রি .) সন্তান। হেমেন্দ্রমোহন বসুও কলকাতার স্পোর্টিং ইউনিয়ন ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি। বাংলার ক্রিকেটের বহু ব্যাটসম্যানের শিক্ষক এই কার্তিক বসু।

কলকাতা টাউন ক্লাবের সাথে দ্বন্দ্বের কারণে জগদিন্দ্রনাথ সেখান থেকে পদত্যাগ করেন সারদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন ও কুলদারঞ্জনসহ । ক্লাব ছাড়লেও ক্রিকেটের নেশায় পাগল জগদিন্দ্রনাথ ক্রিকেট ছাড়তে পারলেন না কিছুতেই। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার বুন্দেল রোডে জগদিন্দ্রনাথ ৪৫ বিঘা বাগান কিনে সেখানে নাটোর পার্ক তথা ক্রিকেট মাঠ ও বসতবাড়ি নির্মাণ শুরু করেন।

নাটোর ইলেভেন

এ সময় রাজশাহীর কমিশনার রাজশাহী শহরে ক্রিকেট, ফুটবল ও পোলো খেলার একটি টুর্নামেন্টের আয়োজন করে আমন্ত্রণ জানালেন জগদিন্দ্রনাথকে। সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কলকাতায় একটি শক্তিশালী ক্রিকেট ও ফুটবল দল গঠন করলেন নাটোরের মহারাজা। তাঁর নেতৃত্বে রাজশাহীতে এসে টুর্নামেন্টে অংশ নিল উভয় দল। ফুটবলের পাশাপাশি রাজশাহী কলেজের শক্তিশালী ক্রিকেট দলকে হারালো মহারাজার ক্রিকেট টিম। বিজয়ীর বেশে কলকাতায় ফিরে এলেন তাঁরা। এই বিজয় ছিল জগদিন্দ্রনাথের খেলোয়াড়ি জীবনের একটি মাইলফলক। এখান থেকেই একটি শক্তিশালী ক্রিকেট দল গঠনের চিন্তা তিনি শুরু করলেন গভীরভাবে।

সমসাময়িককালে কলকাতায় যে কয়েকটি ক্রিকেট দল ছিল, সেখানে দেশি ক্রিকেটার থাকলেও বিদেশি খেলোয়াড়দের প্রাধান্য ছিল বেশি। এই বাস্তবতায় নিজেদের দল গঠনের সময় জগদিন্দ্রনাথ চাইলেন এক শ ভাগ দেশি খেলোয়াড়দের নিয়ে এমন একটি টিম গড়তে, ইউরোপের শক্তিশালী দলগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও যারা জয়ী হতে সক্ষম। সারদারঞ্জনের সঙ্গে পরামর্শের পর জগদিন্দ্রনাথ ঠিক করলেন, বোম্বেসহ ভারতের অন্যান্য প্রদেশ থেকে দক্ষতাসম্পন্ন ভালো ভালো ক্রিকেটার আনবেন। তাঁর দলে তখন সারদারঞ্জন ও তাঁর অন্য দুই ছোট ভাইসহ আরও কয়েকজন দক্ষ বাঙালি ক্রিকেটার রয়েছেন। এরপর শক্তিশালী ক্রিকেট দল গঠনের জন্য অবশিষ্ট যে কয়েকজন খেলোয়াড় আনা হলো, তার অধিকাংশই এল বোম্বে থেকে। বোম্বের বিখ্যাত ক্লাব হিন্দু জিমখানার সভাপতি ছিলেন জগদিন্দ্রনাথের বন্ধু। অতএব ক্রিকেট দল গঠনে তাঁকে খুব বেশি বেগ পেতে হলো না। এভাবেই ১৯০১ সালে জগদিন্দ্রনাথ রায়ের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় কলকাতার বালিগঞ্জের নাটোর পার্কে প্রতিষ্ঠা পেল ‘নাটোর ইলেভেন’ নামে বাঙালিদের একটি ক্রিকেট দল। দলটি ‘নাটোর টিম’ নামেও পরিচিতি পেয়েছিল।

১৯০১ থেকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নাটোর ইলেভেন দল কলকাতাসহ সমগ্র ভারতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশীয় ক্রিকেট দল হিসেবে গণ্য ছিল।

অবশেষে এ ক্রিকেট দলের একজন উপযুক্ত ও পেশাদার প্রশিক্ষক পেতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হলো। নির্দিষ্ট দিনে মহারাজার বালিগঞ্জের বাগানে কয়েকজন প্রার্থী এসে উপস্থিত। জগদিন্দ্রনাথ সারদারঞ্জনকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘স্যার, প্রার্থী উপস্থিত, পরীক্ষা করুন।’ পরীক্ষার পর মনোনীত হলেন একজন প্রার্থী—তখনকার বোম্বে থেকে আসা পারসি খেলোয়াড় মেহতা।

এর মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার টাকা ব্যায়ে নাটোর পার্ককে সুন্দর ক্রিকেট মাঠে পরিণত করেছেন মহারাজা। অতিরিক্ত কয়েক হাজার টাকা খরচায় ক্রিকেট গ্রাউন্ডের পাশে নির্মাণ করেছেন সুন্দর একটি প্যাভিলিয়নও।

এ সবকিছু দেখে মনে হয়, জগদিন্দ্রনাথের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল বাংলার ক্রিকেটকে উন্নত মানে নিয়ে যাওয়া। এ জন্য ১৯০১ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রতিটি ক্রিকেট মৌসুমে কলকাতা শহরের ব্রিটিশ সাহেবদের বিভিন্ন ক্রিকেট দলের সঙ্গে নিয়মিত ম্যাচ খেলার আয়োজন করতেন তিনি। এ ছাড়া স্থানীয় বাঙালি ক্লাবের সঙ্গে খেলা হতো দুটি করে ম্যাচ। কলকাতার বাইরে ভারতের অন্যান্য জায়গাতেও অনেকগুলো খেলায় অংশ নিয়েছিল নাটোর টিম। তখন ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বিখ্যাত ক্রিকেট দলগুলোর সঙ্গেও নাটোর ইলেভেনের খেলা শুরু হয়। এদের মধ্যে ছিল, পাতিয়ালার মহারাজার ক্রিকেট দল, জামনগরের বিখ্যাত রঞ্জিত সিংয়ের ক্রিকেট দল, কোচবিহারের মহারাজার ক্রিকেট দলসহ রাজস্থানের যোধপুর দল, কাশ্মীর (শ্রীনগর) দল, কলম্বো টিম, রেঙ্গুন টিম প্রভৃতি। এই শক্তিশালী ক্রিকেট দলগুলোর সঙ্গে নাটোর ইলেভেনের খেলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নাটোর টিম বিজয়ী হতে থাকে। এভাবে ১৯০১ থেকে শুরু করে ১৯১৪ সালের মধ্যে নাটোর টিম ভারতবর্ষে একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্রিকেট দল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। সে সময় বঙ্গের লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিজের গভর্নর হাউসে জগদিন্দ্রনাথকে নিমন্ত্রণ করে তাঁর সঙ্গে নাটোর ইলেভেন নিয়ে আলাপ–সালাপ করতেন বলেও জানা যায়।

জগদিন্দ্রনাথ ক্রিকেট অনুরাগী ও সুঠাম দেহের অধিকারী হলেও শৈশবেই তাঁর একটি চোখ দৃষ্টিহীন হয়ে পড়ে। ফলে ক্রিকেট খেলা ছিল তাঁর জন্য দুরূহ। তবে বরাবরই নাটোর টিমের দলপতির (ক্যাপ্টেন) ভূমিকা পালন করতেন জগদিন্দ্রনাথ। দলপতি হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ। নাটোর ইলেভেনে সেকালে যেসব বিখ্যাত ক্রিকেটারের সমাবেশ ঘটেছিল, তাঁরা হলেন সারদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন, বালু, বিথাল, শিবরাম, অগাধশংকর, ওয়ার্ডেন, শেষাচারি, রাজ্জাক, আজিজ, রঙ্গলাল, মিস্ত্রী, স্যাম্পর, পুরুষোত্তম, সালামুদ্দীন, বাকু, রাজু, হিমু ও মনু। তাঁদের মধ্যে মনু ছিলেন জগদিন্দ্রনাথের একমাত্র ছেলে। তিনি ছিলেন নাটোর টিমের একজন নিপুণ ব্যাটসম্যান। এই দলের বিখ্যাত বোলার ছিলেন বালু, ওয়ার্ডেন, স্যাম্পর, মিস্ত্রী, পুরুষোত্তম, সালামুদ্দিন, অগাধশংকর প্রমুখ। তাঁদের মধ্যে বালু ছিলেন আবার ভারতের বিখ্যাত বাঁহাতি বোলার। এই টিমের বিখ্যাত ব্যাটসম্যানদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাজ্জাক, বাকু, রঙ্গলাল, মনু ও কুলদারঞ্জন।

জগদিন্দ্রনাথ ও তাঁর ছেলে যোগীন্দ্রনাথ (ডাকনাম মনু) ছিলেন পারদর্শী ক্রিকেটার। অনেক খেলায় জগদিন্দ্রনাথ টিম ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পালন করেছেন। পার্সি খেলোয়াড় মেহতা (মেটা) ছিলেন নাটোর দলের প্রাণ। এ দলে খেলেছেন রাজু, হিমু, বাকু, জাইলুনাবাদের মতো বাঘা দেশি ক্রিকেটার। কুলদারঞ্জন বলেছেন, ‘নাটোর টিমের শিক্ষাগুরু ছিলেন জগদিন্দ্রনাথ স্বয়ং। প্রতিদিন তিনি সকলের আগে প্র্যাকটিস করিয়া Practice –net এর পিছনে বসিয়া থাকিতেন। আমরা অন্যেরা যখন প্র্যাকটিস করিতাম, প্রত্যেকের খেলার দোষক্রটি তিনি তৎক্ষণাৎ সংশোধন করিয়া দিতেন।’

নাটোর ইলেভেন গঠনের শুরুতেই ভারতবর্ষের সেরা বোলারদের নিজ দলে প্রাধান্য দিয়েছিলেন মহারাজা। এর প্রধান উদ্দেশ্য একটিই—বালু, ওয়ার্ডেন বা সালামুদ্দিনের মতো প্রসিদ্ধ বোলারের বিরুদ্ধে খেলতে খেলতে স্থানীয় বাঙালি ব্যাটসম্যানরা যেন দক্ষ হয়ে গড়ে ওঠেন। হয়েছিলও তা-ই। নাটোর ইলেভেনের বিখ্যাত ব্যাটসম্যান কুলদারঞ্জন রায়ের স্মৃতিমূলক রচনা থেকে উদ্ধৃত করা যাক: ‘আমার নিজের অবস্থা দিয়াই বলিতেছি, টাউন ক্লাবে যখন ছিলাম, তখন কোনো ম্যাচে দশ রান করিতে পারিলেই ভাবিতাম খুব খেলিয়াছি, Double figure হইয়াছে। অবশ্য একবার ক্যালকাটা ক্লাবের সঙ্গে খেলায় পঞ্চাশ রানও করিয়াছিলাম, সেদিন মহারাজা খেলায় উপস্থিত ছিলেন। সুতরাং আমার মনে ধারণা ছিল যে আমি খেলোয়াড় “কেউকেটা” নই। কিন্তু সেই আমি প্রথম যেদিন বালুর bowling-এ প্র্যাকটিস করি, সেদিন আমার bat-এর সঙ্গে ball-এর কোনো সম্পর্কই হইল না। যখন চক্ষু খুলিল, বুঝিতে পারিলাম, এত দিন শুধু ছেলে খেলাই খেলিয়াছি, প্রকৃত ক্রিকেট খেলি নাই। ক্রমে মহারাজের শিক্ষাগুণে এবং ভাল bowling-এ প্র্যাকটিস করিবার দরুণ অনেক উন্নতি লাভ করিয়াছিলাম। তখন ম্যাচে ৫০/৬০ রান করিয়া out হইলেও তৃপ্তি হইত না, একশত run (century) করিতে পারিলাম না বলিয়া দুঃখ হইত।’

মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ নাটোর ইলেভেনের সার্বিক উন্নতিকল্পে কেবল বোলিং ও ব্যাটিংয়ে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তা নয়; এই দলকে সে সময় ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে দলের প্রত্যেক ক্রিকেটারকে নিয়মিত ফিল্ডিং প্র্যাকটিস করাতেন তিনি। তিনি নিজেই ছিলেন নাটোর টিমের শিক্ষাগুরু। পেশাদার প্রশিক্ষক নিয়োগ করে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা তো রেখেছিলেনই, দলের ক্রিকেটারদের উন্নতির জন্য করেছিলেন আরও নানা কৌশল। যেমন প্রতিদিন তিনি প্রথমেই নেট প্র্যাকটিস শুরু করতেন। এরপর বসতেন নেটের পেছনে। একে একে প্রত্যেক খেলোয়াড়ের বোলিং ও ব্যাটিং নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। খেলোয়াড়দের ভুলত্রুটি খেয়াল করে প্রশিক্ষকের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। এরপর তাৎক্ষণিকভাবে খেলোয়াড়দের ভুলগুলো সংশোধনও করে দিতেন। প্রত্যেক ক্রিকেটারকে কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে বাধ্যতামূলক ফিল্ডিং প্র্যাকটিস করানো হতো।

মহারাজ জগদিন্দ্রনাথের হাতেই তৈরি হয়েছেন বিখ্যাত ক্রিকেটার মণিদাস ও রঙ্গলাল। ম্যাচ খেলায় কৃতিত্বের পুরস্কার হিসেবে মহারাজ কৃতী খেলোয়াড়দের দামি উপহার দিতেন। কুলদারঞ্জন বলেছেন, ‘নাটোর টিম ক্রিকেট খেলায় ভারতে সর্বশ্রেষ্ঠ দল বলিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। নাটোর টিমের সুখ্যাতি বঙ্গের শাসনকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল।’ একবার যোধপুর-জামনগর টিম কলকাতা এসেছিল। এই টিমে বিলাতের ছয়জন বিখ্যাত খেলোয়াড় ছিলেন। তৎকালীন ক্রিকেট-সম্রাট রণজিৎ সিং সেই টিমের ক্যাপ্টেন। নাটোর পার্কে নাটোর ইলেভেনের সাথে তাদের খেলা হলো। নিষ্পত্তি হলো ড্র হয়ে। ঐ টিমের অগাধশঙ্কর পরে মহারাজের দলে খেলতেন।

যদুনাথ চক্রবর্তী বলেছেন, ‘ মহারাজ স্বয়ং যে একজন সুযোগ্য ক্রিকেট-খেলোয়াড় ছিলেন এবং দেশের ছাত্রবৃন্দকে ক্রিকেট খেলাতে উৎসাহিত করিতে যে তিনি কত আন্তরিক যত্ন লইতেন, তাহা বোধ হয় অনেকেই জানেন না।’ সারাদেশে ক্রিকেটকে জনপ্রিয় করার জন্য জগদিন্দ্রনাথ খ্যাতনামা প্রত্যেক ক্লাবকে খেলায় আহ্বান করতেন। বোম্বাই ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল থেকে প্রতিবছর তিনি খ্যাতনামা খেলোয়াড়দের আনাতেন। এদের মধ্যে বালু, বিঠল, শিবরাম, অগাধশঙ্কর, ওয়ার্ডেন, শেষাচারি, রাজ্জাক, আজিজ, মাসি, শ্যামপার, মিস্ত্রি অন্যতম। কলকাতার মানুষ অপেক্ষায় থাকতো কবে ক্যালকাটা ক্লাব কিংবা বালিগঞ্জ ক্লাবের সাথে নাটোর টিমের খেলা হবে।

কোচবিহার ক্লাবে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড় থাকতে। কিন্তু নাটোর টিমে বিদেশি খেলোয়াড় ছিল না। খেলার মাঠে যাবার জন্য মহারাজ জনে জনে কথা বলে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাঁর অজস্র অর্থব্যয়ে কেনা সরঞ্জাম বৃথা যায়নি। সারদারঞ্জনের সহায়তায় মহারাজের ক্রিকেট টিম ভারত ছাড়াও বিদেশের টিমের সাথে লড়ে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়েছে বারবার। রাজশাহী কলেজের ক্রিকেট টিমের সাথেও মহারাজের টিম জয়ী হয়েছে নাটোর ইলেভেন গঠনের সময়। সে খেলা হয়েছে রাজশাহী কলেজ মাঠে।

এই অপ্রতিরোধ্য নাটোর ইলেভেন টিম সে সময় গোটা ভারতবর্ষে ক্রিকেটের মশাল জ্বেলেছিল। প্রায় ১৪ বছর গৌরবের সাথে টিকে থাকার পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪) শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ‘নাটোর পার্ক’ ইতিহাস হয়ে যায়। ভেঙে যায় নাটোর ইলেভেন টিম।

সমাপনী

ক্রিকেট নিয়ে আমরা অনেক কাহিনি কিংবদন্তি শুনি। তবে বাংলার ক্রিকেটের পুরোধা-পুরুষ জগদিন্দ্রনাথ ও সারদারঞ্জন আমাদের কাছে বিস্মৃত। আমরা তাদের কথা জানি না বললেই চলে। অথচ বাংলার ক্রিকেটের ইতিহাস তাদের কথা বাদ দিয়ে তৈরি হওয়াটা বিস্ময়কর মনে হয়। সারদারঞ্জন রায় ও জগদিন্দ্রনাথ রায়—দুজনেই ছিলেন পূর্বপরিচিত। কিন্তু কলকাতায় এসে এই পরিচয় বন্ধুত্বে পরিণত হলো ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে। আগেই বলেছি, রাজশাহীতে পড়াশোনার সময় ক্রিকেটের সঙ্গে পরিচিত হয়ে এ খেলার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন জগদিন্দ্রনাথ। কলকাতায় এসে সাহিত্যবিষয়ক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তিনি নিজেকে যুক্ত রাখলেও ক্রিকেট বিষয়ে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সারদারঞ্জনের পরামর্শ ও সহযোগিতায়।। তাই হচ্ছে। জগদিন্দ্রনাথের ক্রিকেট ও শরীরচর্চায় অবদান নিয়ে অনেক কথা বলা যায়।

তথ্য সূত্র –

১। মানসী মর্ম্মবাণী, কলকাতা, মাঘ-১৩৩২

২। সমর পাল : পঞ্চদশ প্রসঙ্গ, ১৯৯২

৩। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান

৪। সমর পাল : অনাদৃত অধ্যায়, ২০০৬

৫। অতুল সুর : ৩০০ বছরের কলকাতা ঃ পটভূমি ও ইতিহাস

৬। সমর পাল : নাটোরের ইতিহাস, ১৯৮০

৭। শ্রীহেমেন্দ্রকুমার রায় : যাঁদের দেখেছি ।

৮। প্রথম আলো

৯। নাটোর মহকুমা সম্মিলনী ১৯৮১, পৃ. ৬১-৭৫

১০। মহারাজা জগন্দ্রিনাথ রায়, ফজলুল হক, বাংলা একাডেমি ঢাকা, ১৯৯২।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *