নাটোর ঔষধি গ্রাম

নাটোর শহর থেকে প্রায় পূর্বদিকে ১২ কিলোমিটার দূরে লক্ষীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নের খোলাবাড়িয়া গ্রামের লোকজন ভেষজ গাছের বাগান করে সফলতা এনেছে। বর্তমানে এ গ্রামের প্রায় ৮০% লোক এ পেশার সাথে জড়িত। প্রায় শতাধিক প্রজাতির ঔষধি গুন সম্পন্ন ভেষজ চাষ করে গ্রামের প্রায় দেড় হাজার পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে, পাঁচ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ টাকা মূল্যমানের ভেষজ গাছ ও উপকরণ বিক্রয় হয়। উৎপাদিত ভেষজ দ্রব্যাদি প্রক্রিয়াজাতকরণ করে ঔষধ ও প্রসাধন শিল্প স্থাপনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

এলাকায় প্রবেশের সাথে সাথে রাস্তার দু‘ধারে দেখা যায় ঔষধী গাছের সমারোহ। ঔষধী গাছ গাছড়ার মধ্যে দুধসাগর, পাথরকুচি, কাশাবা, উলুটকমল, কর্ণপলাশ, শিমুল মূল, দাউদ মূল বাসক, তুলশি, ঘৃত কাঞ্চন, শতমুলি, শিমুল, অশ্বগন্ধা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও রয়েছে- বাসক, তুলসী, হরীতকী, বহেরা, তেলাকুচ, কেশরাজ, ধুতরা, পুদিনা, যষ্টিমধু, নিম, অর্জুন, ওলটকম্বল, লজ্জাবতী, হস্তী পলাশ, নিশিন্দা, রাজকণ্ঠ, নীলকণ্ঠ, হিমসাগর, দুধরাজ, ঈশ্বর মূল, রাহু চান্দাল, রক্ত চান্দাল, ভাই চান্দাল, বোন চান্দাল,  ভুঁইকুমড়া, আমরুল, কেয়ামূলসহ শত রকমের ঔষধি গাছ।

অবস্থান

নাটোর সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার পূর্বে ঢাকা রাজশাহী মহাসড়কের পাশে অবস্থিত লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়ীয়া ইউনিয়নের প্রায় ১৫টি গ্রাম নিয়ে গঠিত ঔষধী গ্রাম। এ এলাকার পথের দুই ধার ও জমিতে গাছ আর গাছ। কোনোটিই যেন তেন গাছ নয়, অনেক জটিল রোগ সারে এসব ভেষজ উদ্ভিদে। গাছের পরিচয়েই খোলাবাড়িয়াকে ডাকা হয় ‘ঔষধি গ্রাম’। ঔষধি গুণসম্পন্ন গাছের বদৌলতে বদলেছে গ্রামটির নাম। বদলে গেছে পুরো গ্রামবাসীর জীবনযাত্রা। বদলে গেছে তাদের চিন্তা চেতনা এবং কর্ম।

খোলাবাড়িয়া, কাঁঠালবাড়িয়া, ইব্রাহিমপুর, লক্ষ্মীপুর, সুলতানপুর, চুবারিয়া, পিজ্জিপাড়া, দরারপুর, টলটলিয়াপাড়া,  নতুনবাজার, হাজিগঞ্জ, আমিরগঞ্জসহ ১৫ গ্রাম নিয়ে অবস্থিত ঔষধি গ্রামের ১০০ থেকে ১২০ জন কবিরাজ, ৪০০ থেকে ৫০০ জন হকার, ১০০- ১৫০ জন সাধারণ ব্যবসায়ী এবং ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার কৃষকের জীবন ঔষধি গাছের সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে এসব গ্রামের কৃষকেরা অধিকাংশ কৃষিজমি ও বাড়ির আঙ্গিনার আশেপাশে প্রায় ৩০০ প্রজাতির ঔষধীজাত গাছ গাছড়ার চাষাবাদ করে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করে থাকে।

ঔষধী গাছসমূহ

এই এলাকায় চাষকৃত বিভিন্ন রকমের রকমের ঔষধী গাছের মধ্যে অন্যতম হলো:

১) শতমূল, ২) তালমূল, ৩)শঙ্খমূল, ৪)অনন্তমূল, ৫)ঈশ্বরমূল, ৬)শিমুলমূল ৭) সর্পগন্ধা (রাউলফিয়া সার্পেণ্টিনা) ৮) ঘৃতকুমারী(এ্যালভেরা), ৯) অশ্বগন্ধা ১০) হস্তীকর্ণ পলাশ ১১) রাহু চণ্ডাল ১২) গুরু চণ্ডাল, ১৩)ভাই চণ্ডাল, ১৪)বন চণ্ডাল, ১৫)তুরুক চণ্ডাল, ১৬) রক্ত চণ্ডাল, ১৭) ব্রহ্ম চণ্ডাল, ১৮) রাজ কণ্ঠ, ১৯) রাণী কণ্ঠ ২০) নীল কণ্ঠ ২১) লাল লজ্জাবতি ২২) শ্বেত লজ্জাবতি ২৩)সাদা কুঁচ ২৪)লাল কুঁচ (যষ্টি মধু), ২৫)একাঙ্গী, ২৬)কালমেঘ, ২৭)থানকুনি, ২৮)মিছরিদানা, ২৯)বাসক, ৩০)তেজবল, ৩১)আকন্দ, ৩২)মাসিন্দা, ৩৩) তেলাকুচা, ৩৪) সাদা ধুতরা, ৩৫)কালো ধুতরা, ৩৬) ভূঁই কুমড়া, ৩৭) নিম, ৩৮)নিশিন্দা, ৩৯)বাবর তুলসী, ৪০)লাল তুলসী, ৪১)কৃষ্ণ তুলসী, ৪২) শ্বেত তুলসী, ৪৩)দুর্গা তুলসী, ৪৪)রাজ তুলসী, ৪৫)গন্ধরাজ তুলসী, ৪৬)পাথর কুঁচি, ৪৭)ক্ষেত পাপড়া ৪৮) আপাঙ প্রভৃতি।


অবশ্য এখানে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় ঘৃতকুমারীর। এর পরে শতমূল, শিমুল, হস্তিকর্ণ পলাশ, তাল মূল, ভূঁইকুমড়া, মিছরিদানা, রাজ কণ্ঠ, রাণী কণ্ঠ, নীল কণ্ঠ প্রভৃতির।


এই গ্রামে একটি আরত আছে। আরতের মাধ্যমে প্রতিদিন ট্রাকে এবং বাছের ছাদে করে এখানকার ভেষজ পণ্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠান হয়। সবচেয়ে বেশি ঘৃতকুমারী যায় ঢাকার কাওরান বাজার ও মালিবাগ কাঁচা বাজারে। এ এলাকা ভ্রমণপ্রিয়দের কাছেও দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

ঔষধি গাছের চাষের সময়

কার্তিক মাসে ঘৃত কাঞ্চন, চৈত্র-বৈশাখ মাসে মিসরিদানা, শতমূল, শিমুলের মূল, হস্তীপলাশ, বিজ্জিমূল, পাথরকুচি এবং বছরের বিভিন্ন সময় অন্যান্য ঔষধি গাছের চারা রোপণ করতে হয়। প্রতিদিন গড় উৎপাদন ২০০ থেকে ২৫০ মণ। এসব ঔষধি গাছের ক্রেতারা হচ্ছেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা অনেক কবিরাজ, আয়ুর্বেদিক, ভেষজ বিক্রির হকার ও পাইকাররা।

ঔষধি গ্রামের ভেষজ চাষিদের একত্র করে এ গ্রামে গড়ে উঠেছে লক্ষীপুর খোলাবাড়িয়া ঔষধি গ্রাম সমবায় সমিতি লিমিটেড। এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কবিরাজ মো. আফাজ উদ্দিন পাগলা। গ্রামের ভেষজ বিপ্লবের এই নেপথ্য নায়ক  ২০০৯ সালে কৃষিক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘চ্যানেল আই কৃষি পদক’ পান। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এ সংগঠনে বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৩০ জন।

আফাজ উদ্দিন পাগলা

ঔষধি গাছের চাষাবাদের কারণে আজ গ্রামটি ঔষধি গ্রাম নামেই বেশি পরিচিত। 

আফাজ উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি এ অঞ্চলের মানুষের জীবন বদলে দিয়েছেন। লোকে তাকে আদর করে আফাজ পাগলা বলে ডাকে। আফাজ উদ্দিন তার জীবিকা খুঁজে পেয়েছেন গাছ ও অন্যান্য প্রাণের মাঝে। তিনি 20 বছর বয়সে তার গ্রামে প্রথম ঔষধি গাছের চারা রোপণ শুরু করেন। পরবর্তীতে, যখন তিনি এই জাতীয় গাছগুলির উপকার উপলব্ধি করেন, তখন গাছই তার জীবিকা অর্জনের উপায় হয়ে ওঠে। তিনি তার নিজের ছোটখাটো অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য গাছপালা ব্যবহার করে শুরু করেছিলেন, এবং একবার তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি যে গাছের ঔষধি গুণাবলী বুঝতে শুরু করেছেন, তিনি একজন পেশাদার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আজ তার নাটোরের গ্রামে গ্রামে গেলে দেখা যায়, প্রায় সব বয়সের মানুষই ঔষধি গাছের গুণাগুণ ও ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন।

আফাজ উদ্দিনের পরিবারের বাড়ি ছিল নরসিংদী জেলার রায়পুরা। মা-বাবা, চার ভাই ও এক দত্তক বোনকে নিয়ে ১৯৬০ সালে নাটোরে আসেন। তখন তার বয়স কুড়ি বছর। এখন তার স্ত্রী হেলেনা বেগমসহ তার তিন কন্যা রয়েছে; জুলেখা, ইয়াসমিন ও জেসমিন। তবে মনের দিক থেকে তিনি পারিবারিক মানুষ নন। তিনি ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন। তার সময় গাছপালা রোপন ও যত্নে খরচ হয়। তার এই নেশা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তিনি একজন ভালো সামারিটান হতে পছন্দ করেন এবং গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে লাউচন্ডাল বা তেজবোল বীজ বিতরণ করেন। তিনি আশেপাশের গ্রামে ঘোরাফেরা করেন এবং ঔষধি গাছ সম্পর্কে তার জ্ঞানের কথা ছড়িয়ে দেন এবং কীভাবে তাদের বৃদ্ধি ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়।

প্রায় ৪৫ বছর আগে নাটোরের লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া গ্রামে ঔষধি গাছের চাষ শুরু করেন আফাজ উদ্দিন। পাশাপাশি কবিরাজি চিকিৎসাও শুরু করেন তিনি। এলাকার সবাই তাকে বলে আফাজ পাগলা নামে চেনে। তিনি নিজে ঔষধি গাছ চাষ করেই থেমে থাকেননি, অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করেছিলে ভেষজ উদ্ভিদ চাষে। প্রথমে কেউ গুরুত্ব না দিলেও ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন, এটি লাভজনক। পরে অন্যরাও চাষে যুক্ত হন।

এভাবে ঔষধি গাছের চাষ বাড়তে থাকে খোলাবাড়িয়া গ্রামে। মিসরি দানা, ভূঁইকুমড়া, আলকুচি, তুলসি, হরতকি, আমলকি, বহেরা, বাসক, ঘৃতকাঞ্চন, শতমূলী, শিমুল, অশ্বগন্ধাসহ প্রায় ১৪০ প্রকারের ঔষধি গাছের চাষাবাদ করা হয় এখানে। আজ এ গ্রাম সারা দেশে ঔষধি গ্রাম হিসেবে পরিচিত।

এ গ্রামে উৎপাদিত এসব গাছ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যান। ঔষধি গাছকে ঘিরে স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠেছে ঔষধি বাজার। গ্রামবাসীর উৎপাদিত ভেষজ বাজারজাত করতে গড়ে উঠেছে সমবায় সমিতি।

এখন ঔষধি গাছেই ঘুরছে গ্রামের ১৬শ’ পরিবারের অর্থনীতির চাকা। ‘ঔষধি গ্রাম’ এ নামে গ্রামটিকে পরিচিত করে তোলার নেপথ্যে রয়েছেন আফাজ উদ্দিন।

কৃষিক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৯ সালে ‘চ্যানেল আই কৃষি পদক’ পেয়েছেন আফাজ পাগলা। এছাড়া স্থানীয়ভাবে পেয়েছেন বেশ কয়েকটি পুরস্কার। অবসরে তিনি একাকি থাকতে পছন্দ করতেন। আধ্যাত্মিক গান গাইতেন তিনি। এছাড়া নিজের কবিরাজি চিকিৎসালয় থেকে নানা রোগের চিকিৎসা সেবা দিতেন তিনি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন আসতেন চিকিৎসা নিতে।  

মাটির মনীষী আফাজ পাগলা (তিনি নিজেকে পাগল পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন, তাঁর শিষ্যরা এবং এলাকার লোক তাকেঁ পাগলা বলেই ডাকে), যিনি বাংলাদেশে ভেষজ উদ্ভিদ চাষে বিপ্লব এনেছেন। তাঁর উয্যোগে নাটরের লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নের ১০ টি গ্রামে চাষ হচ্ছে ভেষজ উদ্ভিদ। গ্রামগুলি হচ্ছে: হাজিগঞ্জ, লক্ষীপুর, বড়বাড়িয়া, টলটলিয়া, কালিতলা, নতুনবাজার, ইব্রাহীমপুর, কাঠালবাড়ি, আমিরগঞ্জ ও খোলাবাড়িয়া খামার। খোলাবাড়িয়া খামার এই গ্রামেই আফাজ পাগলার বাড়ি।

প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘ব্যাধিই সংক্রামক স্বাস্থ্য নয়’। প্রমথ চৌধুরীর কথা ভুল প্রমাণিত করেছেন আফাজ পাগলা। তার কারণ; আফাজ পাগলা একজন ১০০% নিরক্ষর মানুস হলেও তাঁর প্রেরণায় ভেষজ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। প্রায় প্রতি দিনই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোক জন আসছেন নানা রকম ভেষজ গাছের সাথে পরিচিত হোতে। তারা ভেষজ চাষ, সংরক্ষণ, বিপনন, গুনাগুন এবং এগুলির প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করছেন। এই দর্শনার্থীর মধ্যে আছেন দেশের নামি-দামি কৃষিবিদ ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী। তার কারণ আফাজ পাগলা এবং ১০টি গ্রামের বিশাল জন গোষ্ঠির কম-বেশি সবাই মিলে সম্মিলিত যে জ্ঞান ধারণ ও পরিচর্জা করছেন তা প্রচলিত শিক্ষাব্যাবস্থায় কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ধারণ ও পরিচর্জা করা সম্ভব না।

তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২০০৪ সালে জাতীয়ভাবে এই এলাকাকে ঔষধী গ্রাম হিসাবে ঘোষণা দিয়েছেন। এই গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে কম-বেশি ২/১টা ঔষধী গাছ আছে, আর বানিজ্যিক ভাবে চাষ করছেন প্রায় ৪৫০ জন কৃষক, কবিরাজ আছে প্রায় ৪০০ জন এবং হকার আছে ১০০ –এর বেশি। এই কবিরাজ ও হকাররা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় তাদের কর্মকাণ্ড বিস্তার করেছেন।

আফাজ পাগলার প্রথম পেশা ছিল বানর খেলা দেখান। প্রায় ৩০ বছর আগে একদিন এক হাটে তিনি বানর খেলা দেখাচ্ছিলেন, তখন পরিচয় হয় আরেক কবিরাজ জলিল পাগলার সাথে। জলিল পাগলা তাঁকে বানর খেলা ছেড়ে কবিরাজি করতে বলেন। তখন তিনি তার কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে গ্রামে এসে কবিরাজি শুরু করেন। কিন্তু, কবিরাজি করতে গিয়ে দেখেন প্রয়জনিয় গাছ-গাছড়ার বড্ড অভাব। তখন থেকে শুরু হয় তার গাছ সংগ্রহের পালা।

আফাজের সাইকেল মেকার ছোট ভাই প্রথমে ২-৩টি ঘৃতকুমারির গাছ এনে দেন ভাইকে। সেই ঘৃতকুমারিই তাঁর বাগানের প্রথম গাছ। সেই ঘৃতকুমারিই এখন নাটর জেলাসহ বাংলা দেশের বিভিন্ন জায়গায় বংশ বিস্তার করেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবত ওয়ালাদের কছে যে ঘৃতকুমারি দেখা যায় তার সিংহ ভাগ যায় নাটরের লক্ষীপুর থেকে। নাটর শহর থেকে পাবনার দিকে যাবার পথে ৭ কি.মি দূরে হয়বতপুর, হয়বতপুর থেকে ৪ কি.মি দক্ষিন-পশ্চিমে আমাদের উদ্দিষ্ঠ মনীষীর বাস।


আফাজ পাগলা নিয়মিত কবিরজী করতেন। বাড়িতেই তার ডিসপেন্সারী। তাঁর তিন মেয়ের দু’জনের বিয়ে হয়েছে। স্ত্রী হেলেন তাঁর কম্পাউণ্ডার। তিনি মাইজ ভাণ্ডারি তরিকার অনুসারি ছিলেন।

আফাজ পাগলা কৃষিক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৯ সালের ‘চ্যানেল আই কৃষি পদক’ ছাড়াও স্থানীয়ভাবে পেয়েছেন বেশ কয়েকটি পুরস্কার।

আর্থিকভাবে হতরিদ্র কিন্তু মনের দিক দিয়ে অনেক বড় আফাজ পাগলার মনের ইচ্ছা এক সময় এই গ্রামে ওষুধের কারখানা হবে, সেই ওষুধ প্লেনে করে বিদেশ যাবে, দেশের মানুষ কাজ পাবে, দু’টা পয়সার মুখ দেখবে। তাঁর নিজের জন্য কোন মানুষের কাছে কোন চাওয়া পাওয়া নেই। সবচেয়ে অদ্ভূত লাগে স্রষ্টার কাছেও তাঁর ব্যাক্তিগত
কিছু চাওয়ার নেই।

যার উদ্যোগে গ্রামটি ঔষধি গ্রামে পরিণত হয়েছে সেই বৃক্ষপ্রেমিক আফাজ উদ্দিন পাগলা ৫ নভেম্বর ২০১৭ দিনগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঘুমের মধ্যে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল প্রায় ৮৫ বছর। তিনি স্ত্রী, তিন মেয়ে ও পালিত এক ছেলেসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।  আর রেখে গেছেন ঔষধী গাছের গ্রাম, স্বপ্নময় ভবিষ্যৎ।

স্থানীয়ভাবে ঔষধি গাছগাছড়ার বাজারও বহুগুণ সম্প্রসারিত হয়েছে। গত দেড় যুগে সেখানে নতুন করে শতাধিক ঔষধি পণ্যের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সাতটি কারখানা গড়ে উঠেছে। সেখানে একটি ঔষধি বাজারও গড়ে উঠেছে। চাষি ও ব্যবসায়ীরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। দোকানে দোকানে ইন্টারনেট সুবিধা, অনলাইন আদান-প্রদান ও প্রচার এখন নিত্যদিনের ঘটনা।

কবিরাজ আফাজ উদ্দিন চার বছর আগে মারা গেলেও তাঁর স্বপ্ন বাস্তবরূপ পেয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে ঔষধি গাছের চাষের এই সাফল্য থেকে কৃষি অধিদপ্তরসহ সরকারের নীতিনির্ধারকদের অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। কেননা অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত কৃষির বহুমুখীকরণ। নাটোরের বদলে যাওয়া ঔষধি গ্রাম সেই দৃষ্টান্তই স্থাপন করেছে।

কৃষিমন্ত্রীর নাটোরের ঔষধি গ্রাম পরিদর্শন

নাটোর সদর উপজেলার খোলাবাড়িয়া গ্রাম ঔষধি গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এ গ্রামের লোকজন ভেষজ গাছের বাগান করে সফলতা পেয়েছেন। বর্তমানে গ্রামটির প্রায় ৮০ শতাংশ লোক এ পেশার সঙ্গে জড়িত। ৩ জুন ২০২২ তারিখ সকালে নাটোরের খোলাবাড়িয়ার এ ঔষধি গ্রামটি পরিদর্শন করেন কৃষিমন্ত্রী মো. আবদুর রাজ্জাক।

এতে করে প্রায় সাড়ে চার হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। এ গ্রাম থেকে প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার ভেষজ গাছ ও উপকরণ বিক্রি হয়। ১৯৯৫ সালে আফাজ উদ্দীন নামে এক ব্যক্তি প্রথম এ গ্রামে ঘৃতকুমারী গাছের চারা এনে রোপণ করেন। গ্রামটিতে সারা বছর ১ হাজার ৫০ বিঘা জমিতে ঘৃতকুমারী (অ্যালোভেরা), শিমুল মূল, অশ্বগন্ধাসহ প্রায় ১০০ প্রজাতির ভেষজ ঔষধি গাছের চাষ হয়।

এ সময় কৃষিমন্ত্রী ঘৃতকুমারী বা অ্যালোভেরার মাঠ পরিদর্শন এবং কৃষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। খোলাবাড়িয়া গ্রামে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ কৃষক ঘৃতকুমারীসহ বিভিন্ন ঔষধি ফসল চাষ করছেন। ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, বাজারজাতে সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা এ সময় কৃষকেরা তুলে ধরেন এবং ঔষধি ফসল চাষের সুরক্ষায় ও বিকাশে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *