নাটোরের দর্শনীয় স্থান

“বিল চলন গ্রাম কলম কাঁচাগোল্লার খ্যাতি
অর্ধ বালেশ্বরী রানী ভবানীর স্মৃতি
উত্তরা গণভবন রাজ-রাজন্যের ধাম
কাব্যে ইতিহাসে আছে নাটোরের নাম।”

ঐতিহ্যের জৌলুস, অতীতের রাজ-রাজন্যের স্মৃতি, প্রাচীনত্ব আর ইতিহাসের সোনালি দিনগুলোর নীরব সাক্ষী নাটোর জেলা । রাজশাহী বিভাগের অন্তর্গত জেলাটির রয়েছে সৌন্দর্য, সংস্কৃতি, সম্পদ, সূর্যসন্তানের এক অনবদ্য ইতিহাস, আলোকিত বর্তমান এবং সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ ।

Table of Contents

নাটোরের দর্শনীয় স্থান

নাটোর জেলা বিভিন্নমুখী সাজে অপরূপ। ইতিহাস, ঐতিহ্যসহ বিল-ঝিল, পার্ক, জাদুঘর রয়েছে সারা জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সব ধরণের মানুষের জন্য রয়েছে অনেক দর্শণীয় স্থান, এই আর্টিকেলে কয়েকটি সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেনঃ

উত্তরা গণভবন

নাটোর শহর থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে এক মনোরোম পরিবেশে ইতিহাস খ্যাত দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী তথা উত্তরা গণভবন অবস্থিত । নাটোরের রানী ভবানী তাঁর নায়েব দয়ারামের উপরে সন্তষ্ট হয়ে তাঁকে দিঘাপতিয়া পরগণা উপহার দেন রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন-১৯৫০ এর মাধ্যমে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর ১৯৫২ সালে দিঘাপতিয়ার শেষরাজা প্রতিভানাথ রায় সপরিবারে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান । ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূবর্ পাকিস্হান সরকারের নিয়ন্ত্রনে আসে এবং সংস্কার হয়ে এর নাম হয় গভর্নর হাউস । দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের স্হপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান দিঘাপতিয়া গভর্নর হাউসকে উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষণা করেন, যা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাঞ্চলীয় বাসভবন হিসেবে পরিচিত ।

আয়তন ও অবস্থান

দিঘাপতিয়া রাজ প্রাসাদটি নাটোর শহর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে নাটোর সদর উপজেলাধীন দিঘাপতিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত। প্রাসাদটি প্রাচীন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য স্থাপত্যকলার মিশেলে তৈরি এক অপূর্ব নিদর্শন।চতুর্দিকে ১০ ফুট উঁচু সুদৃঢ় সীমানা প্রাচীর বেষ্টিত রাজবাড়িটি ৪১.৫ একর জায়গায় অবস্থিত এবং প্রাচীরের বাহিরে প্রধান ফটকের সামনে রয়েছে আরও ২.৮৯ একর জমি।

দিঘাপাতিয়া রাজবাড়ি বা উত্তরা গণভবন বাংলাদেশের নাটোর শহর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে এককালের দিঘাপাতিয়া মহারাজাদের বাসস্থান এবং বর্তমান উত্তরা গণভবন (Uttara Ganabhaban) বা উত্তরাঞ্চলের গভর্মেন্ট হাউস।

প্রাসাদের মূল অংশ এবং সংলগ্ন কিছু ভবন নির্মাণ করেছিলেন রাজা দয়ারাম রায়। রাজবংশের ষষ্ঠ রাজা প্রমদা নাথ রায়ের আমলে ১৮৯৭ সালের ১০ জুন নাটোরের ডোমপাড়া মাঠে তিনদিনব্যাপী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের এক অধিবেশন আয়োজন করেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি এ অধিবেশনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগ দেন। অধিবেশনের শেষ দিন ১২ জুন প্রায় ১৮ মিনিটব্যাপী এক প্রলয়ংকরি ভূমিকম্পে রাজপ্রাসাদটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। পরে রাজা প্রমদা নাথ রায় ১৮৯৭ সাল থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত ১১ বছর সময় ধরে বিদেশী বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী ও চিত্রকর্ম শিল্পী আর দেশী মিস্ত্রিদের সহায়তায় সাড়ে ৪১ একর জমির উপর এই রাজবাড়ীটি পুনঃ নির্মাণ করেন।

সাড়ে ৪১ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত প্রাসাদটি পরিখা ও উচু প্রাচীর ঘেরা। প্রাসাদের পূর্বপাশে পিরামিড আকৃতির চারতলা প্রবেশদ্বার রয়েছে যা উপরের দিকে সরু হয়ে গেছে এবং এর উপরে একটি ঘড়িও রয়েছে। মধ্যযুগীয় বাংলাদেশের অন্যান্য সামন্ত প্রাসাদের মতোই নাটোরের রাজবাড়ীতে রয়েছে দীর্ঘ প্রবেশ পথ যার দু ধারে বোতল পামের সুবিন্যাস লক্ষনীয়। নাটোরের ঐতিহাসিক দিঘাপতিয়ার রাজবাড়ী বর্তমানে উত্তরা গণভবন। প্রায় তিনশত বছরের প্রাচীন ঐতিহাসিক ঐতিহ্যবাহী দিঘাপাতিয়া রাজবাড়ীটি নাটোরের উত্তরা গণভবন নামে পরিচিত। বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম নাটোর দিঘাপতিয়ার উত্তরা গণভবন। দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দয়ারাম রায়। তিনি নাটোরের রাজা-মহারাজ রামজীবনের একান্ত অণুগত একজন দেওয়ান ছিলেন। নাটোর রাজের উত্থানে দয়ারাম রায় অসামান্য ভূমিকা রাখায় ১৭০৬ সালের দিকে রাজা রামজীবন উপহার হিসেবে বাসস্থানের জন্য তাকে দিঘাপতিয়ায় কিছু জমি দান করেন। পরবর্তীতে জমিদার ও রাজা হওয়ার পর ১৭৩৪ সালে দয়ারাম রায দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।

উত্তরা গণভবনের প্রবেশ পথের বিশাল ফটকটি আসলে একটি বিরাটাকৃতির পাথরের ঘড়ি। ঘড়িটি রাজা দয়ারাম সেই সময় ইংল্যান্ড থেকে আনিয়েছিলেন। ঘড়িটির পাশে রয়েছে একটি বড় ঘণ্টা। এক সময় এই ঘণ্টাধ্বনি বহুদূর থেকে শোনা যেতো। প্রাসাদের ভিতর বহু প্রাচীন ও দুর্লভ প্রজাতির গাছের সমাবেশ ও সমারোহ। ঢাকার জাতিয় স্মৃতিসৌধের শোভাবর্ধনকারী রোপণকৃত ফুল ব্রাউনিয়া ও ককেসিয়া এখানকারই। এছাড়া অন্যান্য বৃক্ষের মধ্যে এখানে আছে রাজ-অশোক, সৌরভী, পরিজাত, হাপাবমালি, কর্পূর, হরীতকী, যষ্টিমধু, মাধবী, তারাঝরা, মাইকাস, নীলমণিলতা, হৈমন্তীসহ বিভিন্ন দুর্লভ প্রজাতির ফলজ ও ঔষধি বৃক্ষ। প্রাসাদের মধ্যে পরিখা বা লেকের পাড়ে এসব বৃক্ষাদির মহাসমারোহ।

প্রাসাদের প্রবেশ পথের চারিদিকে প্রাসাদঘেরা পরিখা যা পুরো রাজপ্রাসাদকে ঘিরে রেখেছে। ভেতরে বিশাল মাঠ ও গোলাপ বাগান একপাশে গণপূর্ত অফিস। দ্বিতল হলুদ ভবনটি কুমার প্যালেস নামে পরিচিত। নিচতলাটি টর্চারসেল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। একটি একতলা তহশিল অফিস আছে। সে সময়কার চারটি কামান পরিলক্ষিত হয়। কামানগুলোর স্থাপনকাল ছিল ১৭৯৯ সাল। বিশাল রাজদরবার সংলগ্ন বাগানে জমিদার দয়ারামের একটি ভাস্কর্য তার স্মৃতিচারণ প্রতীক। প্রাসাদের মধ্যে একটি মিলনায়তন ভবনসহ রযেছে আরো দুইটি ভবন। গাড়ি পার্ক করার গ্যারেজ আলাদা। যাবতীয় স্থাপনা মাঝখানে। প্রাসাদের ভেতর রয়েছে বিভিন্ন ব্যবহার্য জিনিসপত্র। ভবনের মধ্যে জাদুঘর, বহু দর্শনীয় স্মৃতিস্তম্ভ, ভাস্কর্য ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য বিদ্যমান।প্রাসাদের পিছন দিকে রয়েছে ফোয়ারা সহ একটি সুদৃশ্য বাগান। বাগানের এক কোণে রয়েছে প্রমাণ আকৃতির মার্বেল পাথরের তৈরি একটি নারী মূর্তি।

ইতালিয়ান গার্ডেন উত্তরা গণভবনের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য অংশ। গার্ডেনটির আসবাবপত্র রাজা দয়ারাম ইটালি থেকে আনিয়েছিলেন। ছিপ হাতে কালো রঙের মার্বেল পাথরের মূর্তিটি উপভোগ্য। বেঞ্জগুলো কোলকাতা থেকে আনানো হয়েছিল। পাহাড়িকন্যা পাথরের মূর্তিটির এক হাত ভাঙা। হাতের কবজিটি স্বর্ণ দিয়ে বাঁধাই করা ছিল। এখানে রাণীর টি হাউসটি অতুলনীয়।

উত্তরা গণভবন চত্বরে গোলপুকুর, পদ্মপুকুর, শ্যামসাগর, কাছারিপুকুর, কালীপুকুর, কেষ্টজির পুকুর নামে ছয়টি পুকুর রয়েছে। এছাড়া গণভবনের ভেতরের চারপাশে সুপ্রশস্ত পরিখা রয়েছে। প্রতিটি পুকুর পরিখায় সানবাঁধানো একাধিক ঘাট আছে। দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় পুকুরগুলো ভরাট হয়ে গিয়েছে। ঘাট ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। প্রাচীন এই অবকাঠামোকে ঘিরে অজস্র আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, মেহগনি, পাম ও চন্দনাসহ দুর্লভ জাতের গাছ লাগানো ছিল। অযত্ন আর অবহেলায় ইতোমধ্যে অনেক গাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
উত্তরা গণভবনের নামফলক

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দিঘাপতিয়ার শেষ রাজা প্রতিভা নাথ রায় দেশ ত্যাগ কের চলে যান। এসময় থেকে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী পরিত্যাক্ত অবস্থায় থাকে। ১৯৫০ সালে জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হওয়ার পর দিঘাপতিয়ার রাজ প্রাসাদটির রক্ষণা-বেক্ষণে বেশ সমস্যা দেখা দেয়। ১৯৬৫ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার রাজবাড়ীটি অধিগ্রহণ করেন। সমস্যা সমাধানে দিঘাপতিয়ার মহারাজাদের এই বাসস্থানকে ১৯৬৭ সালের ২৪শে জুলাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর আব্দুল মোনায়েম খাঁন দিঘাপতিয়ার গভর্ণরের বাসভবন (The East Pakistan Governor’s house of Dighapatia) হিসেবে উদ্বোধন করেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এক আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে এর নাম পরিবর্তন করে উত্তরা গনভবন ঘোষণা করেন। তিনি ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এই ভবনের মূল প্রাসাদের ভিতর মন্ত্রিসভার বৈঠক আহবান করেন। সেই থেকে ভবনটি ‘উত্তরা গণভবনের’ প্রকৃত মর্যাদা লাভ করে।

উত্তরা গণভবন পরিদর্শনের সময়সূচী

গ্রীষ্মকালে সকাল ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত উত্তরা গণভবন দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকলেও শীতকালে ৫ টায় তা বন্ধ করে দেয়া হয়। সপ্তাহের প্রতি রবিবার উত্তরা গণভবন বন্ধ থাকে। গণভবনের আঙিনায় প্রবেশ করতে ২০ টাকা মুল্যের টিকেট ক্রয় করতে হয়।

কিভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে সড়ক ও রেলপথে নাটোর যাওয়া যায়। নাটোর বাস স্টপ কিংবা রেলস্টেশন থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশায় উত্তরা গণভবন যেতে মাত্র ১৫ মিনিট সময় লাগে। অথবা নাটোরের যে কোন জায়গা থেকেই উত্তরা গণভবনে যাওয়ার পর্যাপ্ত রিক্সা বা অটোরিক্সা পাবেন। নাটোরের মাদ্রাসা মোড় থেকে উত্তরা গণভবন যেতে ৩০ টাকা রিকশা ভাড়া লাগে।

বাসে ঢাকা থেকে নাটোর

ঢাকা থেকে নাটোর যাওয়ার বেশকিছু বাস সার্ভিস রয়েছে এদের মধ্যে গ্রীণ লাইন, হানিফ, দেশ ট্রাভেলস, শ্যামলী এবং ন্যাশনাল পরিবহন উল্লেখ্য। এসব পরিবহণের বাসগুলো নিয়মিতভাবে ঢাকার কল্যানপুর ও গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে নাটোরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।

ট্রেনে ঢাকা থেকে নাটোর

ঢাকা থেকে সাধারনত রংপুর, দিনাজপুর, লালমনিরহাটগামী নিলসাগর এক্সপ্রেস, রংপুর এক্সপ্রেস, একতা এক্সপ্রেস, দ্রুতযান এক্সপ্রেস, কুরিগ্রাম এক্সপ্রেস, লালমনি এক্সপ্রেস ও পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেনগুলো নাটোর স্টেশনে যাত্রা বিরতি দিয়ে গন্তব্যের পথে এগিয়ে যায়।

কোথায় থাকবেন

নাটোরে মোটামুটি মানের কতগুলো আবাসিক হোটেল ও বোডিং রয়েছে। হোটেল ভি.আই.পি (0771-66097, 01718-673735) এবং হোটেল রুখসানায় (0771-62431, 01739-987017) সিংগেল কেবিন ২৫০ থেকে ৩০০ ও ডাবল কেবিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা ভাড়ায় রাত্রি যাপন করতে পারবেন।
এছাড়া যোগাযোগ করতে পারেন সার্কিট হাউস নাটোর (0771-66932), নাটোর সদর ডাক বাংলো, হোটেল প্রিন্স (0771-61356, 01746-029429), নাটোর বোর্ডিং (0771-62001), হোটেল রাজ (0771-66660, 01727-371500) কিংবা হোটেল মিল্লাতে।

কোথায় খাবেন

উদরপূর্তির জন্য নাটোরে বেশকিছু বিভিন্ন মানের রেস্টুরেন্ট রয়েছে। নিজের পছন্দ মত যেকোন রেস্টুরেন্টে সকাল, দুপুর ও রাতের খাবার খেতে পারবেন। কম খরচে খাওয়ার জন্য ইসলামিয়া পঁচুর হোটেলের বেশ সুনাম রয়েছে। এছাড়া রেলস্টেশনের কাছে নয়ন হোটেলের খাবারও বেশ ভাল। সমগ্র বাংলাদেশে চলনবিল এবং রানী ভবানী সুস্বাদু মাছের সুনাম ছড়িয়ে আছে। তাই নাটোর ভ্রমনকালে মাছ খাওয়ার এই সুযোগ মিস করা মোটেও ঠিক হবে না। সাথে নাটোরের বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা খেয়ে সাথে করে নিয়েও আসতে পারেন।

রাণী ভবানী নাটোর রাজবাড়ী, বঙ্গজ্জল, নাটোর সদর, নাটোর

প্রাচীন জনপদ নাটোর জেলায় সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত রাণী ভবানী রাজবাড়ী (Rani Bhawani Rajbari) কে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৬ সালে রাণী ভবানী কেন্দ্রীয় পার্ক হিসাবে ঘোষনা করে। রাণী ভবানী কেন্দ্রীয় পার্কে রয়েছে ৬ টি দীঘি এবং শ্যামসুন্দর, তারকেশ্বর শিব এবং আনন্দময়ী কালিবাড়ি নামের ৩ টি মন্দির, যেগুলাতে এককালে রাজকীয় ভাবে পূজা – আর্চনার আয়োজন করা হত। রা্ণী ভবানী রাজবাড়ি নাটোর রাজবাড়ি (Natore Rajbari) নামেই অধিক পরিচিত।

রানী ভবানী রাজবাড়ী বড় তরফ ও ছোট তরফ নামক দুটি অংশে বিভক্ত। ১২০ একর আয়তনের রানী ভবানী রাজবাড়ী কমপ্লেক্সে ছোট বড় মোট ৮ টি ভবন রয়েছে। কিছুটা মতভেদ থাকলেও নিশ্চিত ভাবে বলা যায় ১৭০৬ থেকে ১৭১০ সালের মধ্যে নাটোরের রানী ভবানী রাজবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছিল। তৎকালীন পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ণের কাছ থেকে ১৮০ বিঘা আয়তনের একটি বিল রাজা রাম জীবন দান হিসাবে গ্রহন করে এই রাজবাড়ী ও অন্যান্য স্থাপনা গড়ে তোলেন। বড় তরফ অংশের মূল কমপ্লেক্সটিই রানী ভবানীর রাজ প্রসাদ হিসাবে ব্যবহৃত হত। নাটোর রাজবাড়ি প্রতিদিন সকাল ৯ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।

কিভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে সড়ক ও রেলপথে নাটোর যাওয়া যায়। আর নাটোর শহর থেকে রিক্সা বা টেম্পু ভাড়া করে সরাসরি রাণী ভবানী রাজবাড়ী ভ্রমণ করতে পারবেন।

নাটোর শহরের যে কোন স্থান থেকে সরাসরি রিক্সা বা অটোরিক্সা যোগে যাওয়া যায়। শহরের মাদ্রাসা মোড় থেকে রাজবাড়ীর রিকশা ভাড়া ২০ টাকা। 

যাতায়াতের জন্য রিক্সা বা অটোরিক্সা রিজার্ভ না নেয়াই ভাল। কেননা নাটোর শহরের সকল স্থানেই স্থানীয় যানবাহন পর্যাপ্ত চলাচল করে।

চলন বিল

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিলের নাম চলন বিল (Chalan Beel)। নাটোর, সিরাজগঞ্জ এবং পাবনা জেলাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট অনেকগুলো বিলের সমষ্টি এই চলন বিল। বর্ষায় দ্বীপের মত ভাসমান সবুজ গ্রাম, শীতে অতিথি পাখির কলরব, সুনীল আকাশ এবং শরতে বিলের পাড় ধরে ফোটে থাকা কাশবনের সৌন্দর্য আগত দর্শনার্থীদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। শুধুমাত্র ভরা বর্ষায় চলন বিলের প্রকৃত রূপ ধরা পড়ে। আর তখন প্রায় ৩৬৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জলে একাকার হয়ে যায়। বর্ষাকাল ছাড়াও প্রায় সারাবছরই চলন বিলের বুকে নৌকায় ভেসে বেড়াতে কিংবা বিলের বৈচিত্রপূর্ণ সৌন্দর্য উপভোগ করতে অসংখ্য পর্যটক ছুটে আসেন।

একসময় চলন বিলের মোট আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইল বা প্রায় ১৪২৪ বর্গকিলোমিটার। তবে বর্তমানে চলন বিলের আয়তন কমে ১১৫০ বর্গ কিলেমিটারে পরিণত হয়েছে। চলন বিলের সাথে ছোট ছোট অসংখ্য বিল খালের মাধ্যমে এসে যুক্ত হয়েছে। পিপরূল, লারোর, ডাঙাপাড়া, তাজপুর, নিয়ালা, মাঝগাঁও, চোনমোহন, শাতাইল, দারিকুশি, গজনা, বড়বিল, সোনাপাতিলা এবং ঘুঘুদহ তেমনি কিছু বিলের নাম।

চলন বিলের বুকে মিশে গেছে করতোয়া, আত্রাই, গুড়, বড়াল, মরা বড়াল, তুলসী, ভাদাই সহ বেশ কয়েকটি নদী। মাছে সমৃদ্ধ চলন বিলে আছে চিতল, মাগুর, কৈ, শিং, বোয়াল, টাকি, শোল, মৃগেল, চিংড়ি, টেংরা, কালিবাউশ, রিটা, মৌসি, গজার, বৌ, সরপুটি, পুঁটি, গুজা, গাগর, বাঘাইর কাঁটা, তিতপুটি সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ।

চলনবিলে ঘুরে বেড়াতে পারেন নৌকায় করে। সাধারণ নৌকা আর ইঞ্জিন নৌকা দুই-ই পাবেন। দরদাম করে ভাড়া ঠিক করে নিতে হবে। সাঁতার না জানলে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে নেবেন।

চলন বিল কিভাবে যাবেন

রাজধানী ঢাকা হতে চলন বিল যেতে হলে রাজশাহীগামী বাসে চড়ে নাটোরের কাছিকাটা নামক স্থানে নামলে সবচেয়ে সুবিধা হবে। ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল এবং গাবতলী বাস টার্মিনাল হতে এই রুটে চলাচল করে। নাটোরের কাছিকাটা থেকে চলন বিলের দূরত্ব প্রায় ১৩ কিলোমিটার।

কাছিকাটা থেকে চাচকৈর বাজার হয়ে খুবজীপুর গ্রামে আসতে পারবেন। খুবজীপুর গ্রাম থেকে নাটোর অংশের চলন বিলের সৌন্দর্য সবচেয়ে ভালভাবে উপভোগ করতে পারবেন। আর হাতে সময় থাকলে চলন বিল জাদুঘর ঘুরে জেনে নিতে পারেন চলন বিলের অজানা বিষয়াদি।

আর ঢাকা হতে ট্রেনে যেতে চাইলে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশান থেকে খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস, রাজশাহীগামী সিল্কসিটি এক্সপ্রেস, পদ্মা কিংবা লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেনে চড়ে সদানন্দপুর স্টেশনে নামুন। সদানন্দপুর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরত্বে রয়েছে সিরাজগঞ্জ জেলা শহর। তবে ট্রেনে গেলে সহজে চলন বিলের সিরাজগঞ্জ অংশে যেতে পারবেন।

চাপিলা শাহী মসজিদ, গুরুদাসপুর, নাটোর

গুরুদাসপুর থেকে চাপিলা ইউনিয়ন পরিষদ রোড হয়ে মহারাজপুর দিয়ে রিক্সা/ভ্যান যোগে চাপিলা শাহী মসজিদে যাওয়া যায়। গুরুদাসপুর থেকে চাপিলা ইউনিয়ন পরিষদ রোড হয়ে মহারাজপুর দিয়ে রিক্সা/ভ্যান যোগে চাপিলা শাহী মসজিদে যাওয়া যায়।

গুরুদাসপুর উপজেলার চাপিলা ইউনিয়নের চাপিলা গ্রামের মুঘল শাসমনামলে মোঘল সৈনিকদের ফারি ছিল । সে কারণে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। চাপিলা ৩ গম্বুজ মসজিদটি দর্শনীয় স্থান।

গুরুদাসপুর উপজেলার পাটপাড়া গ্রামে মসজিদের ৩টি গম্বুজ আছে ও ৫টি দরজা আছে। মসজিদটি ১৬২৮-১৬৫৮ সালে নির্মিত। বাদশা শাহজাহান এর পুর সুজা বাংলার গর্ভনর নিযুক্ত হন। বাদশা সুজা মিয়া এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। পার্শ্বে একটি পুকুরও আছে। পুকুরে দুটি ঘাট আছে। সম্রাট শাহজাহান এর পুত্র সুজা মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন।মসজিদটির দৈর্ঘ ৪৬র্ এবং প্রস্থ ২০র্ । ৫টি দরজা ও ৩টি গম্বুজ আছে। পাঁচশত বছরের পুরাতন মসজিদ। বর্তমানে মুসল্লীগণ নামাজ আদায় করেন।  ইহা দর্শনীয় স্থান।

গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের কুসুম হাটি গ্রামে সুলতানী আমলে নির্মিত মসজিদ । মসজিদটির দৈর্ঘ ৪০র্ এবং প্রস্থ ও ২০র্ । আয়তন অনুসারে প্রতীয়মান হয় যে, সম্রাট শাহজাহান এর পুত্র সুজা মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। মসজিদটির ৩টি দরজা ও ৩টি বড় গম্বুজ ও ৮টি ছোট গম্বুজ আছে। মসজিদটির বহু কারুকার্য খচিত নক্সা রয়েছে। এমনকিট গম্বুজের উপরেও নক্সা রয়েছে।

দয়ারামপুর রাজবাড়ি, বাগাতিপাড়া, নাটোর।

নাটোর শহর থেকে অটো বা বাসযোগে দয়ারামপুর রাজবাড়ি যাওয়া যায়। অটো রিসার্ভ করলে ভাড়া- ১৫০ টাকা । 

নাটোর শহর থেকে অটো বা বাসযোগে দয়ারামপুর রাজবাড়ি যাওয়া যায়। অটো রিসার্ভ করলে ভাড়া- ১৫০ টাকা । 

বাংলার রাজা-জমিদারদের মধ্যে দিঘাপতিয়া রাজবংশ একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। দয়ারাম রায় এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর জন্মবৃত্তান্ত আজো রহস্যাবৃত্ত। কারো মতে, দয়ারাম রায় কলম গ্রামের এক তিলি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। রামজীবন যখন পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়ন ঠাকুরের অধীনে সাধারণ একজন কর্মচারী তখন দয়ারাম তাঁর মাসিক ৮ আনা বেতনে চাকুরী করতেন। পরে সামান্য লেখাপড়া করে জমা খরচ রাখার মত যোগ্যতা অর্জন করেন এবং রামজীবন তাকে মাসিক ৮ আনার পরিবর্তে ৫ টাকা বেতনের মহুরী নিযুক্ত করেন। পরবর্তীতে পুঠিয়ার রাজা দর্পনারায়নের স্নেহ, ভালবাসা ও সহানুভুতি, নবাব সরকারের ভ্রাতা রঘুনন্দনের প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং বাংলার নবাব দেওয়ান মুর্শিদকুলী খানের নেক-নজর সবকিছু মিলে যখন রামজীবন জমিদারী লাভ করেন তখন তারও ভাগ্য খুলতে থাকে। অনেকের মতে রামজীবন জলবিহারোপলক্ষ্যে চলনবিলের মধ্য দিয়ে কলম গ্রামে পৌছেন। সে সময় দু’জন বালক রাজার নৌকার সামনে উপস্থিত হয়। দু’টি বালকের একজনের কথাবার্তা ও বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে তিনি তাকে নাটোরে নিয়ে আসেন। বালকটিই দয়ারাম রায়।

দয়ারাম রায় সিংড়া থানার কলম গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কলমের নরসিংহ রায়ের সন্তান তিনি অনুমান ১৬৮০ সালে তার জন্ম। প্রথমে রাজা রামজীবনের একজন সাধারণ কর্মচারী এবং প্রতিভাবলে নাটোর রাজের দেওয়ান পর্যন্ত হয়েছিলেন। রামজীবন তাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করতেন এবং প্রচুর অর্থ-সম্পদ তার কাছে গচ্ছিত রাখতেন। রাজা সীতারাম রায়ের পতনের পর দয়ারাম নাটোর রাজ্যের একজন পরাক্রমশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। যশোহরের রাজা সীতারাম রায় বিদ্রোহী হলে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ নাটোর রাজের দেওয়ান দয়ারাম রায়ের সাহায্যেই দমন ও পরাজিত করে নাটোর কারাগারে বন্দী করেন। সীতারাম রায়কে পরাজিত করায় নবাব সরকারের প্রভাব বেড়ে যায় এবং ‘‘রাই রাইখা’’ খেতাবে ভূষিত হন। সীতারাম রায়কে পরাজিত করে তিনি তার মূল্যবান সম্পদ সমূহ লুন্ঠন করেন, কিন্তু গৃহদেবতা কৃষ্ণজীর মূর্তি ছাড়া সব রামজীবনের হাতে তুলে দেন। দয়ারামের এহেন ব্যবহারে তিনি খুশী হয়ে কৃষ্ণজীর মূর্তি স্থাপনের জন্য দিঘাপতিয়ায় একখন্ড জমি কয়েকটি পরগণা দান করেন। নিঃসন্তান রামজীবন দেওয়ান দয়ারামের পরামর্শেই রামকান্তকে দত্তক গ্রহণ করেন এবং পুত্র রামকান্ত ও ভ্রাতুস্পুত্র দেবী প্রসাদের মধ্যে জমিদারী ভাগ করে নিতে চান। কিন্তু দেবী প্রসাদের একগুঁয়েমী মনোভাবের জন্য সমগ্র জমিদারী রামকান্তের নামে উইল করে দেন। রামকান্তের বিবাহের সময় তিনিই ছিলেন সর্বময় কর্তা। কন্যা পছন্দ, দিন-তারিখ নির্ধারণ, যৌতুক আদায়, আত্মীয়-স্বজনদের নিমন্ত্রণ সব কিছুর ভারই অর্পিত ছিল দেওয়ান দয়ারামের উপর। রামজীবন মৃত্যকালে দয়ারাম রায়কেই পুত্রের একমাত্র অভিভাবক নিযুক্ত করে যান।

রামকান্ত বালক মাত্র, তাই রাজশাহীর মতো ব্যাপক ও বিস্তৃত জমিদারী পরিচালনা করা তার পক্ষে অসম্ভব। এজন্য প্রকৃত কর্তৃত্ব ছিল দযারাম রায়ের উপর। তাঁর সুদক্ষ ও নিপুণ পরিচালনায় জমিদারীর মর্যাদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। সরফরাজ খাঁনের সময় ১৩৯ পরগনার স্থলে রাজশাহী জমিদারী গরগণার সংখ্যা দাড়ায় ১৬৪ তে। রামকান্ত বয়ঃপ্রাপ্ত হলে স্বাধীনভাবে এবং স্বহস্তে জমিদারী পরিচালনার ইচ্ছা প্রকাশ করলে দয়ারাম রায় অবসর গ্রহণ করেন এবং দিঘাপতিয়ায় রাজবাড়ী নির্মাণ করতে থাকেন। যুবক রামকান্ত বিরাট জমিদারী, প্রচুর সম্পদ, সুন্দরী স্ত্রী, অশেষ মান-সম্মান লাভ করে সুখ-স্বাচ্ছন্দে ছিলেন। কিন্তু দয়ারাম রায়ের অবসর গ্রহণের পর কিছু অসাধু আমাত্যবর্গ দ্বারা পরিবেষ্ঠিত হন এবং বিভিন্ন প্রকার আমোদ-আহলাদে কালাতিপাত করতে থাকেন। পুন্যবতী স্ত্রী রাণী ভবানীর শত উপদেশ সত্ত্বেও যথারীতি রাজকার্য পরিচালনায় মনোনিবশে করতে পারেননি। ফলে নবাব সরকারের প্রচুর রাজস্ব বাকি থাকে। এ সময় দয়ারাম রাজকার্যে মনোনিবেশ এবং যথারীতি রাজস্ব প্রদান করতে উপদেশ দেন

। নবাব আলিবর্দ্দী খাঁ জমিদারী দেবী প্রসাদকে অর্পন করলে অবশেষে দয়ারাম রায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং জগৎশেঠের সহযোগিতায় পুনরায় তা ফিরে পান। ১৭৪৮ সালে রাজা রামকান্তের মৃত্যু হলে দয়ারাম রায় রাণী ভবানীর পাশে থেকে জমিদারী পরিচালনা করেন। তাঁর সুদক্ষ পরিচালনায় রাণী বর্গীয় আক্রমণের সমস্যা কিছুই বুঝতে পারেননি। রাণী ভবানীর একমাত্র কন্যা তারার বিয়ের সময় তিনিই ছিলেন প্রধান কর্মকর্তা। জামাতা রঘুনাথের মৃত্যুর পর দয়ারামই তাকে দত্তক গ্রহণে সম্পূর্ণ সাহায্য করেন। রাণী ভবানী দয়ারাম ও তারা এ দু’জনের সাথে পরামর্শ করেই কার্য পরিচালনা করতেন। রাণী ভবানী দয়ারামকে অত্যন্ত বিশ্বাস করতেন এবং অনেক সময় নিজ নামে কার্য পরিচালনার সুযোগ দিতেন। দয়ারাম সে সময়ে রাণীর পরামর্শ ছাড়া বাহ্মণদের ব্রহ্মোত্তর দান করেন। এ বিষয়ে রাণী ভবানীর কোন আপত্তি ছিল না, কারণ তাঁর বিশ্বাস বৃদ্ধ মন্ত্রী দয়ারাম রায় নাটোর রাজের মঙ্গল ছাড়া কোন সময়ে অমঙ্গল কামনা করেন না। কিন্তু রাজকুমারী তারা দয়ারামের এ কাজটিকে সমর্থন করতে পারেননি। তাঁর মতে, রাজকর্মচারী অন্য কোন কাজ করলেও প্রকৃত মালিকের অনুমতি না নিয়ে ভূ-সম্পত্তি দান করতে পারেন না। তিনি দান অসিদ্ধ ঘোষনা করেন।

দয়ারাম রায় এ সময়ে রাণী ভাবানীর সাথে সাক্ষাৎ করে সব কথা খুলে বলেন। প্রকাশ্য যে, ভবানীর বিবাহের সময় রামজীবনের পরিবর্তে দয়ারাম রায়ই বিবাহের কাগজে সহি করেন। দয়ারাম রায় সেই জীর্ণ কাগজটি রাণীর সামনে ধরে বলেন যে, যদি দয়ারামের স্বাক্ষরে ব্রহ্মোত্তর অসিদ্ধ হয়, তবে এ বিয়েও সিদ্ধ হয়নি। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে তারা সুন্দরী মনোভাব ত্যাগ করেন এবং দয়ারামের কাছে ক্ষমা প্রার্থণা করেন। ১৭৬০ সালের দিকে রাণী ভবানী একবার রাজ্যচ্যুত হন। সে সময়ে দয়ারাম রায় কিছুদিনের জন্য জেল খাটেন বটে, কিন্তু রাণী ভবানীকে রাজ্য ফিরিয়ে দিয়ে তবেই তিনি ক্ষান্ত হন। নাটোর রাজের গগণস্পর্শী উত্থানে দেওয়ান দয়ারাম রায়ের অবদান অনস্বীকার্য। কখনও তিনি সেনানায়ক রূপে শক্ত হাতে অশি পরিচালনা করেছেন, কখনও বিদ্ব্যান ব্যক্তির মত কলম হাতে নিয়ে জমিদারীর হিসাব রেখেছেন। কখনও ভূষণায়, কখনও ভাতুরিয়ায়, কখনও বড়নগর-মুর্শিদাবাদে ছুটাছুটি করেছেন। রঘুনন্দন নাটোর রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন সত্য কিন্তু দেওয়ান দয়ারমের সুদক্ষ পরিচালনার জন্য উক্ত রাজবংশ তৎকালে এত খ্যাতি অর্জন করতে পেরেছিলেন।

লর্ড ক্লাইভ এদেশে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠা করেন সত্য কিন্তু লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস সে শাসন ব্যবস্থাকে স্থায়িত্ব দেন। কিশোরী চন্দ্র মিত্র রঘুনন্দনকে নাটোর রাজের ‘‘ক্লাইভ’’ এবং দয়ারামকে ‘‘ওয়ারেন হেস্টিংস’’ বলে অভিহিত করেছেন। নাটোর রাজের উত্থান ও শ্রীবৃদ্ধিতে দেওয়ান দয়ারাম রায়ের যে অশেষ অবদান ছিল সেকথা স্বীকার করে মৃত্যুর ২শত বছর পরেও উক্ত রাজবংশের মহারাজা শ্রী যোগীন্দ্রনাথ দৃঢ়কন্ঠে বলেছেন, ‘‘রাই রাইয়া দয়ারাম রায় নাটোর রাজবংশের কতখানি আপন জন ছিলেন সেকথা জানিতেন দয়ারাম, জানিতেন তৎকালীন নাটোরাধিপাতিগণ এবং জানে বাংলার ইতিহাস। তাঁহার কথা লিখিতে গেলে বহুশত পৃষ্ঠা লিখিলেও তাঁহার অদ্ভুত ও অপূর্ব গুণরাজি সম্পূর্ণ আলোচনা করা সম্ভব হইবে না

১৭৬০ সালে ৮০ বছর বয়সে তিনি ৫ কন্যা, ১ পুত্র ও প্রচুর সম্পদ রেখে ইহলীলা ত্যাগ করেন। দেওয়ান দয়ারাম রায়ই প্রথমে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ী নির্মাণ করেন যা এখন উত্তরা গণভবন নামে খ্যাত।

দিঘাপতিয়া রাজা প্রমথনাথ রায়ের (১৮৪৯-১৮৮৩) জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রমদানাথ রায় ১৮৯৪ সালে দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর তার তিন কনিষ্ঠ ভ্রাতা কুমার বসন্ত কুমার রায়, কুমার শরৎকুমার রায় এবং কুমার হেমেন্দ্রকুমার রায়ের জন্য বড়াল নদীর তীরে নন্দীকুজা নামক স্থানে ‘‘দিঘাপতিয়া জুনিয়র রাজ দয়ারামপুর এস্টেটস’’ স্থাপন করেন। তাদের প্রপিতামহের পিতাসহ নাটোরের রাণী ভবানীর অসাধারণ দক্ষ দেওয়ান ও দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা দয়ারামপুরের নামানুসারে এই এলাকার নাম হয় দয়ারামপুর, আর বাড়ীর নাম হয় ‘‘দয়ারামপুর জমিদারবাড়ী’’। মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ অবদান রাখায় পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে শহীদ লেঃ কর্ণেল আব্দুল কাদিরের নামে এই জায়গায় কাদিরাবাদ সেনানিবাস স্থাপিত হয়।

ফকিরচাঁদ বৈষ্ণব গোঁসাইজির আশ্রম, লালপুর, নাটোর।

নাটোর সদর থেকে বাস ও অটোরিক্সা যোগে যাওয়া যায়।

লালপুর উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে দুড়দুড়িয়া নওপাড়ায় (পানসীপাড়া) গহীন অরণ্যে ১১০৪ বঙ্গাব্দে বটগাছের নীচে আস্তানা স্থাপন করেন ফকির চাঁদ বৈষ্ণব। এখানেই সাধু ধ্যান, তপস্যা ও বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার আরম্ভ করেন।

মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ, সান বাঁধানো বিশাল পুকুর, নয়নাভিরাম প্রাধান ফটক, অতিথিশালা, ভক্তশালা ও অনুপম শৈলীতে গড়া বিশাল আশ্রম। প্রতি বছর দোল পূর্ণিমা, গঙ্গা-সড়বান ও নবানড়ব উৎসব উপলক্ষে দেশ-বিদেশের সহস্রাধিক ভক্ত-সাধক সমবেত হতেন। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এখনো অনুষ্ঠানের সময় অসংখ্য মানুষ এখানে সমবেত হন।

সাধু ফকির চাঁদ বৈষ্ণবের মৃত্যুর পর নওয়াপাড়ার জমিদার তারকেশ্বর বাবু তাঁর স্মরণে সমাধিটি পাকা করে দেন। ভক্তদের সুবিধার্থে জমিদার ৬৮ বিঘা জমি এবং সান বাঁধানো বিশাল দু’টি পুকুর আশ্রমের নামে দান করেন। আশ্রম চত্ত্বরে দালান-কোঠা নির্মাণেও তিনি সহযোগিতা করেন।

বনপাড়া লুর্দের রাণী মা মারিয়া ধর্মপল্লী, বনপাড়া, বড়াইগ্রাম, নাটোর।

নাটোর সদর থেকে বাস ও সিএনজি অটোরিক্সা যোগে প্রথমে বনপাড়া যেতে হবে; ভাড়া- ৩০ টাকা। 

এরপর বনপাড়া থেকে রিকশাযোগে সরাসরি চার্চে যাওয়া যায়; রিকশা ভাড়া- ২০ টাকা।  

লুর্দের রাণী মা মারীয়া ধর্মপল্লী তথা বনপাড়া ক্যাথলিক মিশন। খ্রিস্টধর্ম পরিচালনা কর্তৃপক্ষকে বলা হয় খ্রিস্টমন্ডলী বা সংক্ষিপ্তাকারে শুধু মন্ডলী। মন্ডলী কর্তৃপক্ষের মূল পরিচালনা কেন্দ্র ভাটিকান বা রোম। স্থানীয়ভাবে খিস্টধর্ম বিশ্বাসী জনসাধারনকে পরিচালনা ও আধ্যাত্মিক পরিচর্যা করা/সেবা দানের উদ্দেশ্যে গঠিত/পরিচালিত একটি সাংগঠনিক কর্মএলাকাকে ধর্মপল্লী বলা হয়। ‘লুর্দের রাণী মা মারিয়া ধর্মপল্লী’ ঈশ্বরপুত্র যীশু খ্রিস্টের জাগতিক জননী মারীয়া বা মরিয়ম-এর পূণ্য নামের স্মৃতিতে উৎসর্গিত।

নাটোর জেলার দক্ষিন সিমানায় বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া পৌরসভার ৫টি ও ১ নং জোয়াড়ী ও ৫ নং মাঝগ্রাম ইউনিয়নের ২টি সহ মোট ০৭টি গ্রাম নিয়ে এই ধর্ম পল্লী প্রতিষ্ঠিত। ঐতিহ্যবাহী বড়াল নদীর দক্ষিনে বনপাড়া নামক একটি গ্রামে ধর্মপল্লীর জন্য নির্ধারিত র্গীজাটি অবস্থিত। যেখানে ১৯৪০ সালের দিকে প্রথম স্বর্গীয় ফাদার থমাস কাত্তানের(পিমে), একজন ইতালীয় ধর্মযাজক সর্ব প্রথম আসেন এবং ছবিতে দেওয়া গীর্জাঘরটি স্থাপিত হয় ১৯৫৮ সালে।

ধর্মপল্লীর অর্ন্তগত গ্রামগুলিতে প্রায় ৭ হাজার ক্যাথমিক খ্রিস্টধর্ম বিশ্বাসী মানুষ বসবাস করেন। খ্রিস্ট বিশ্বাসীগণের মধ্যে ৯৫ শতাংশ বাঙ্গালী এবং ৫ শতাংশ সাঁওতাল ও অন্যান্য আদিবাসী। সাধারণত, খ্রিস্ট বিশ্বাসীগণ এলাকার গ্রামগুলোতে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীগণের সাথে (ইসলাম ধর্মাবলম্বী- মুসলমান ও সনাতন ধর্মাবলম্বী-হিন্দু) মিলেমিশে পাশাপাশি বসত করেন।

ধর্মপল্লী বা গির্জা প্রশাসনের অধিনে একটি হাই স্কুল (সেন্ট যোসেফস্ উচ্চ বিদ্যালয়) ও দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয় (সেন্ট যোসেফস্ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সেন্ট জেভিয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়) পরিচালিত হয়। এছাড়া প্রায় ৪৫০ দরিদ্র আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রীর অবস্থানের জন্য পৃথক ছাত্র ও ছাত্রীনিবাস পরিচালিত হয়। এলাকার হাজার হাজার দরিদ্র নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের জন্য একটি সেলাই কেন্দ্র পরিচালিত হয়। এছাড়া এলাকার প্রসূতি মায়েদের সেবা দানের জন্য উনিশ শ ষাটের দশকে এখানে স্থাপিত হয় দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র যা এলাকার হাজার হাজার প্রসূতি মাকে নিরাপদ মাতৃত্বে সহায়তা প্রদান করেছে। ধর্মপল্লী কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা, আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সহযোগীতায় এখানে বহু ব্রীজ-কালভাট ও রাস্তাঘাট নির্মিত রয়েছে। মূলত এ এলাকার শিক্ষা, সামাজিক, অর্থনৈতিক, যোগাযোগ ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নে এখানকার গির্জা কর্তৃপক্ষ ও খ্রিস্ট বিশ্বাসীগণের রয়েছে বিরাট ভূমিকা।

বর্তমানে দুইজন পুরোহিত ধর্মপল্লী পরিচালনা ও পরিচর্চার দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। তারা হলেনঃ (১) ফাদার দিনো জ্যাকোমিনেল্লী, পিমে, (২) ফাদার আন্তনী হাঁসদা।

শহীদ সাগর, গোপালপুর, নাটোর

১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ লালপুর উপজেলার গোপালপুরের ৪ কিলোমিটার উত্তরে ময়না গ্রামে খান সেনাদের এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পরেরদিন পাক সেনাদের মেজর রাজা খান চুপিসারে পালানোর সময় স্থানীয় জনগণ তাকে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া ঈশ্বরদী বিমান বন্দরে যেন পাক সেনা অবতরণ করতে না পারে সেজন্য স্থানীয় মুক্তিকামী জনগণ মিলের বুলডোজারসহ অন্যান্য যানবাহনের সহায়তায় বিমান বন্দরের রানওয়ে ভেঙ্গে অকেজো করে দেন।

এ ঘটনার প্রেক্ষিতে গোপালপুরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল তবুও অত্র এলাকার আখচাষীদের স্বার্থে জাতীয় প্রতিষ্ঠানটি চালু রাখার জন্য মিলের সকলেই যার যার দায়িত্বে ন্যস্ত ছিল।

সেদিনছিল ৫ মে, চারিদিকে থমথমে অবস্থার মধ্যেও মিলের কাজ চলছিল। সকাল ১০-০০ টার দিকে লাল শালু কাপড়ের ব্যান্ড পরা কিছু রাজাকারের সহায়তায় পাক হানাদার বাহিনীর একটি দল অতর্কিতে মিল ক্যাম্পাসের ভিতরে প্রবেশ করে এবং ময়নার যুদ্ধ এবং পাক সেনা কর্মকর্তার হত্যার মিথ্যা অভিযোগে তৎকালীন মিলের প্রশাসক জনাব লেঃ আনোয়ারুল আজিম এবং অন্যান্য কর্মকর্তা, শ্রমিক-কর্মচারীদের ডেকে বর্তমান অতিথি ভবনের সামনের পুকুরের পার্শ্বে ব্রাশ ফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করে পুকুরের পাড়ে ফেলে চলে যায়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর উল্লিখিত পুকুরটি ‘‘শহীদ সাগর’’হিসেবে নামকরণ হয়। যতদুর জানা যায় ‘‘শহীদ সাগর’’নামকরণের পূর্বে পুকুরটি ‘গোপাল সাগর’নামে পরিচিত ছিল। উল্লেখ্য ১৯৭৩ সালে শহীদ আনোয়ারুল আজিম এর স্মরণে স্থানীয় গোপালপুর রেলওয়ে ষ্টেশনটি ‘‘আজিমনগর ষ্টেশন’’নামে অভিহিত হয়।

১৯৭১ সালের ৫ মে নাটোর জেলার গোপালপুরের আজিমপুর এলাকার নর্থ বেঙ্গল চিনি কারখানায় পাকবাহিনীর নির্মমতা ও গণহত্যার এক জ্বলন্ত সাক্ষী শহীদ সাগর (Shahid Sagar)। পাকিস্থানি সেনারা সুগার মিলের শতাধিক কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিককে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সুগার মিলের অতিথি ভবনের সামনের পুকুর পাড়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। সেদিন গোপাল সাগর হিসেবে পরিচিত পুকুরের পানি শহীদদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠেছিল। যদিও এই ঘটনায় কয়েকজন ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর দুঃসহ স্মৃতিবিজরিত এই পুকুরটিকে শহীদ সাগর নামকরণ করা হয়। ১৯৭৩ সালের ৫ মে শহীদ সাগর চত্বরে শহীদ লে. আনোয়ারুল আজিমের স্ত্রী বেগম শামসুন্নাহার স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করেন | শহীদের স্মরণে শহীদ সাগর স্মৃতিস্তম্ভ ও স্মৃতিস্তম্ভের পূর্ব দিকে একটি ফুলের বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। ২০০০ সালের ৫ মে শহীদ সাগর চত্বরে একটি স্মৃতি যাদুঘর নির্মাণ করা হয়। প্রতিবছর ৫ মে নানা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে গোপালপুরের শহীদের স্মরণে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল গনহত্যা দিবস পালন করা হয়।

সিঁড়িতে যেসকল যায়গায় বুলেটের গুলিবিদ্ধ হয়েছিল, সেসকল জায়গায় আজ প্রতীকি লাল রঙে শহীদের রক্তের চিহ্ন আছে | জনশ্রুতি আছে স্বাধীনতার কয়েক বছর পরেও এই পুকরের পানির রং শহীদদের জমাট বাধা চাপচাপ রক্তে লাল হয়ে ছিল |

কিভাবে যাবেন

নাটোর জেলা সদর থেকে বাস, সিএনজি বা অটোরিক্সায় চড়ে প্রায় ৩১ কিলোমিটার দূরে নর্থ বেঙ্গল চিনি কারখানায় অবস্থিত শহীদ সাগর পৌঁছাতে পারবেন।

কোথায় থাকবেন

রাত্রিযাপনের জন্য নাটোরের মাদ্রাসা মোড় ও রেলওয়ে ষ্টেশনে হোটেল ভিআইপি, হোটেল মিল্লাত, হোটেল প্রিন্স, হোটেল রাজ, হোটেল রুখসানা ও নাটোর বোর্ডিং সহ বেশকিছু আবাসিক হোটেল রয়েছে।     

কোথায় খাবেন

নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের কাছে অর্পিতা কফি হাউজ ও গোপালপুর বাজারে হালকা খাবার খেতে পারবেন। নাটোর শহরের বনপাড়াতে ওয়ান সেভেন হোটেল, হোটেল ফাইভ স্টার, মোল্লা হোটেল এবং ক্যাফে হট ও চিলির মতো বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। নাটোরের জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে মাছ ও কাঁচাগোল্লা অন্যতম।

হালতি বিল, নলডাংগা, নাটোর 

হালতির বিল বা হালতি বিল নাটোর সদর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তরে নলডাঙ্গা থানার অন্তর্গত বিল। এটি অত্র অঞ্চলের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

বিনোদন কেন্দ্র হিসাবে এখানে পাটুল থেকে খাজুরা পর্যন্ত যে রাস্তা আছে সেটাই বেশি আকর্ষনীয়। বর্ষায় যখন পানিতে পরিপূর্ণ হতে থাকে বিল, তখন এই রাস্তার সৌন্দর্য বাড়তে থাকে। পর্যটকের ভিড় তখন বাড়তে থাকে।

বিলের ভিতরে দ্বীপের মত যে ছোট ছোট গ্রাম আছে, সেগুলো আরো মনোমুগ্ধকর।

উত্তরাঞ্চলে কোনো সমুদ্র নেই, তাই এ অঞ্চলের মানুষের কাছে সমুদ্রসৈকত এক স্বপ্ন। তবে নাটোরের হালতি বিল এখন সমুদ্রের অভাব অনেকটাই পূরণ করছে এই এলাকার সাগরপিয়াসী মানুষদের। হালতি বিলের উত্তাল জলরাশি আর ঢেউ যে কারো মন নিমেষেই ভালো করে দেয়ার মত। বর্ষায় অথৈ পানি আর শীতে ফসলি জমির এই বিলের মাঝ বরাবর ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক নির্মাণ করা হয় ২০০৪ সালে।

নাটোর শহরের মাদ্রাসা মোড় থেকে জনপ্রতি ৩০ টাকা করে অটোতে যাওয়া যায়, তবে অটো রিসার্ভ করে গেলে ভাড়া ২০০ টাকা 

চলনবিল জাদুঘর

চলনবিলের স্বপ্নদ্রষ্টা অধ্যক্ষ এম এ হামিদ ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর চলনবিল অঞ্চলের কিছু সচেতন সমাজকর্মীদের সহযোগিতায় গুরুদাসপুর থানার খুবজীপুর গ্রামে অস্থায়ীভাবে চলনবিল জাদুঘর (Chalanbil Museum) প্রতিষ্ঠিত হয়। চলনবিলের বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন নিয়ে তৈরী এ জাদুঘরটি ১৯৮৯ সালের ২ জুলাই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত হয়। চলনবিল জাদুঘরে উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে আছে বিষ্ণু ও মাতৃকা মূর্তিসহ নানা গবেষণা গ্রন্থ, কষ্টি পাথরের সূর্যদেব, ডাক টিকিট, ৯০টি দেশের মুদ্রা, ঘট, শিলা এবং বিভিন্ন শাসন আমলের টেরাকোটা।

এছাড়া এখানে আরো আছে বাদশা আলমগীর ও সম্রাট নাসিরুদ্দিনের নিজ হাতে লেখা দুটি কোরান শরীফ, তুলট কাগজের উপর হাতে লেখা প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো ৮টি সম্পূর্ণ ও ৭টি আংশিক কোরান শরীফ, ১৫টি হাদিস শরীফ এবং ২৫৭টি বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থ।

চলনবিল জাদুঘরের সময়সূচী

গ্রীষ্মকালে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এবং শীতকালে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলনবিল জাদুঘর সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে। প্রতি রবিবার জাদুঘর বন্ধ থাকে আর সোমবার খোলা থাকে বেলা ২টা থেকে। আর প্রতিদিন দুপুর ১টা থেকে ১ টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত জাদুঘরে সাময়িক বিরতি থাকে।

কিভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে বাসে চড়ে নাটোর বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে সেখান থেকে অটো রিক্সা ভাড়া করে সরাসরি চলনবিল জাদুঘর যাওয়া যায়।

বাসে ঢাকা থেকে নাটোর: ঢাকা থেকে নাটোর যাওয়ার বাস সার্ভিসের মধ্যে গ্রীণ লাইন, হানিফ, দেশ, শ্যামলি এবং ন্যাশনাল পরিবহন ইত্যাদি উল্লেখ্য। এসব বাস ঢাকার কল্যানপুর ও গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে নিয়মিতভাবে নাটোরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। বাসের মানভেদে জনপ্রতি টিকেটের মূল্য নন-এসি ৩৮০ টাকা এবং এসি ৬০০ টাকা।

গ্রীন ভ্যালী পার্ক

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন্ডিত গ্রীন ভ্যালী পার্ক (Green Valley Park) নাটোর জেলার লালপুর উপজেলা শহর থেকে মাত্র 2 কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে উঠা সুবিশাল এই বিনোদন কেন্দ্রটি শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকল বিনোদনপ্রেমী ও দর্শনার্থীদের প্রানকেন্দ্র।

প্রায় ১২৩ বিঘা জমির উপর নয়নাভিরাম এ গ্রীন ভ্যালী পার্কটিতে বিনোদনের জন্য রয়েছে স্পীডবোট, প্যাডেল বোট, বুলেট ট্রেন, মিনি ট্রেন, নাগরদোলা, পাইরেট শীপ, ম্যারিগোরাউন্ড, হানি সুইং ইত্যাদি।

এছাড়াও রয়েছে প্রায় ত্রিশ একর জমির উপর বিস্তৃত নয়নাভিরাম লেক। লেকের আঁকা-বাকা বাহারী পথচলা আর পানি পথের রাজা অর্থাৎ দূরন্ত গতির স্পিডবোটে ঘুরে আপনার মন সতেজ হবেই। সাথে আছে বাহারী ফুলের মন মাতানো সুবাসী গন্ধ।

পিকনিক, শ্যুটিং স্পট, এ্যাডভেঞ্চার রাইডস, কনসার্ট এন্ড প্লে গ্রাউন্ড, সভা-সেমিনার এর জায়গা, আবাসিক ব্যবস্থাসহ নানা ধরনের সুবিধা খাকায় গ্রীন ভ্যালী পার্কটি খুবই জনপ্রিয়।

কিভাবে যাবেন গ্রীন ভ্যালী পার্ক

ঢাকা থেকে সরাসরি বাসযোগে যেতে হলে ইশ্বরদী-বাঘা বাসে করে বাঘা এসে নামতে হবে। তারপর সি এন জি যোগে লালপুর যেতে হবে, ভাড়া জনপ্রতি ২০/২৫ টাকা।

রাজশাহী থেকে যেতে চাইলে চারঘাট-বাঘার বাসে করে বাঘা এসে নামতে হবে। তারপর সি এন জি যোগে লালপুর যেতে হবে, ভাড়া জনপ্রতি ২০/২৫ টাকা। ২ ঘন্টা সময় লাগবে পৌছাতে।

নাটোর বাইপাস থেকেও যেতে পারেন সেক্ষেত্রে ৩৫ টাকা বাস ভারা করে লালপুর যেতে হবে তারপরে ১০ টাকা ভ্যান ভাড়া করে পার্কে যেতে পারবেন।

ট্রেনে যেতে টাইলে আবদুলপুর বাইপাসে নামতে হবে, তার পর সেখান থেকে ১২ কি.মি. পথ অতিক্রম করে লালপুর যেতে হবে।

গ্রীন ভ্যালী পার্কের অন্যান্য সুযোগ সুবিধার মধ্যে আছে শ্যুটিং স্পট, পিকনিক স্পট, এ্যাডভেঞ্চার রাইডস, কনসার্ট এন্ড প্লে গ্রাউন্ড, সার্বক্ষনিক নিরাপত্তা ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, নামাজের স্থান, ডেকোরেটর, কার পার্কিং, ক্যাফেটেরিয়া, শপ, সভা-সেমিনারের স্থান এবং আবাসিক ব্যবস্থা।

প্রবেশ টিকেটের মূল্য ও সময়সূচী

*প্রবেশ টিকেট =৫০ টাকা।
*প্রতিটি রাইডের মুল্য প্রায় ৩০-৫০ টাকা।
*গাড়ি পার্কিং=১০-৩০০টাকা।
*সর্বমোট ১০ টি রাইড রয়েছে।
*কোন প্রকার খাবার আনা যাবে না।
*পার্ক সপ্তাহে ৭ দিন ই খোলা থাকে।
*সকাল ৯ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত খোলা।

ওয়াটার পার্ক টিকেট = ৩০০ টাকা (১২টা থেকে ৪টা)
ওয়াটার পার্ক লকার ফি = ৫০-৫০০ টাকা।

টিন সেডের ভাড়া ৫০০০টাকা এবং নরমাল সেডের ভাড়া ২৫০০টাকা এবং সাথে রান্নার জন্য রান্না ঘর আছে। আপনি চাইলে আগে থেকে বুকিং দিতে পারবেন

তিশিখালি মাজার


চলনবিলের ঐতিহ্যবাহী ঘাঁসি দেওয়ান পীরের মাজার রয়েছে এখানকার দর্শনীয় স্থানের তালিকায়। সেখানে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে খয়রাত বা মানসা করতে আসেন লোকজন। সেখানে নামাজের জন্য রয়েছে একটি মসজিদও।

নাটোরের সিংড়া উপজেলা শহর থেকে প্রায় পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে চলনবিলের মাঝখানে অবস্থিত হজরত ঘাসি দেওয়ান (রহ.)-এর মাজার শরিফ, লোকে যাকে ‘তিসিখালি মাজার’ বলে চিনে থাকেন।

ঐতিহ্যবাহী তিসিখালি মেলার প্রচলন বহু বছর আগে থেকে। মাজার তৈরি ও মেলা শুরুর সঠিক ইতিহাস কোথাও তেমন লিপিবদ্ধ নেই। লোকমুখে এই মাজার ও মেলাকে নিয়ে অনেক কিংবদন্তি শুনতে পাওয়া যায়। জনশ্রুতি আছে, বড়পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর নির্দেশে হজরত ঘাসি দেওয়ান (রহ.) সুদূর আরব থেকে নাটোর জেলায় আসেন। তার আসল নাম কেউ না জানলেও হজরত ঘাসি দেওয়ান (রহ.) বা ‘ঘাসি বাবা’ নামটি লোকমুখে প্রচলিত। হজরত ঘাসি দেওয়ান (রহ.)-এর জীবনাচরণ ও নামকরণের বিষয়টি সম্পর্কে আরো জোরালো কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। তা হলো, চলনবিলের ফসলি জমিতে একসময় প্রচুর তিসি বা তিল ফলের চাষ হতো। মাঠে বেড়ানোর সময় একদিন দেওয়ান সাহেব মালিকের অনুমতি ছাড়া একটি তিল মুখে দেন। হঠাৎ দৈববাণীতে তিনি তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত বোধ করেন এবং মালিকের কাছে নিজের ক্ষমা লাভের আশায় তাকে খুঁজতে থাকেন। স্থানীয় ডাহিয়া গ্রামে এক ঘোষ পরিবার ছিলেন সেই জমির মালিক। তার কাছে বারো বছর বিনা বেতনে চাকরের কাজের জন্য আবেদন করেন। উল্লেখ্য, জমির মালিক ছিলেন হিন্দু ধর্মের লোক। দয়াবশত তিনি দেওয়ানকে রাখালের কাজ দেন। তার কাজ ছিল গবাদিপশুর দেখভাল করা এবং তাদের  জন্য চলনবিলের মাঠ থেকে ঘাসের জোগান দেওয়া।

কিন্তু ক্রমেই তার কিছু অলৌকিক ঘটনা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং সবাইকে অবাক করে দেয়। এসব অলৌকিক ঘটনা হজরত ঘাসি দেওয়ান (রহ.)-কে করে তোলে অনন্য। অবশেষে বারো বছর বিনা বেতনে শ্রমের পর তিনি মুক্ত হন এবং তার আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করে সেই মালিকের পরিবার হজরত ঘাসি দেওয়ান (রহ.)-এর কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। দেখতে দেখতে তার অগণিত অনুসারী জুটে যায় এবং তিনি এ অঞ্চলে নির্বিঘ্নে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে শুরু করেন ও জনসেবায় ব্রতী হন। পরবর্তী সময়ে তার মৃত্যুর পর সবাই কবরটিকে হজরত ঘাসি দেওয়ান (রহ.)-এর মাজার হিসেবে বিবেচনা করে আস্তানা গড়ে তোলেন।

তিশিখালি মাজারে কিভাবে যাবেন


নাটোর সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার অদূরে সিংড়া উপজেলা। সিংড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু উত্তরে বালুয়া বাসুয়া মোড়, বর্তমানে এ মোড় চলনবিল গেট নামে পরিচিত লাভ করেছে।এখান থেকে ভ্যানে, মটর সাইকেল কিংবা অটোতে চড়ে যে কেউ যেতে পারবেন চলনবিলে। ভাড়া ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকায় সহজেই চলনবিল পর্যটন পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্র পযর্ন্ত গিয়ে দর্শনার্থীরা নৌকা যোগে তিশিখালী ঘাসি বাবার মাজার সহ চলনবিলে আগত দর্শনার্থীরা এই প্রকৃতির লীলাভূমি উপভোগ করতে পারবেন।

সমসখলসীর পাখি গ্রাম

নাটোর জেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে নিভৃত এই গ্রাম সমসখলসী ।প্রায় সারা বছরই এই গ্রামের ফসলের মাঠ, পুকুরপাড়, আম, কাঁঠাল, শিমুল, তেঁতুল, খেজুর, তালগাছ আর বাঁশঝাড় সবখানেই হরেক প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। প্রতিদিন পাখির কিচিরমিচির শব্দে আর কলকাকলিতে ঘুম ভাঙে গ্রামবাসীর। গ্রামের বিভিন্ন স্থানে শামুকখোল, পানকৌড়ি, দোয়েল, ঘুঘু, শালিকসহ নানান জাতের দেশি পাখির দেখা মেলে।

দেশীয় নানা প্রজাতির পাখির সঙ্গে শীতের শুরুতেই এসে যোগ দেয় ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখি। পরিযায়ী পাখির মধ্যে অধিকাংশই ছোট সরালি, বড় সরালি, খঞ্জনা, পাতিহাঁস প্রজাতির। এসব পাখি স্বাচ্ছন্দ্যে গাছে বিচরণ করে। ঝাঁকে ঝাঁকে ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় ইচ্ছেমতো। উপযুক্ত পরিবেশ ও নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে নির্ভাবনায় আবাস গড়ে তোলে পাখিরা। ফলে পুরো শীতকালজুড়ে এ গ্রামে দেখা যায় দেশি-বিদেশি পাখির মিতালি।

পাখি দেখতে প্রতিদিনই আসেন দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা। এ নিয়ে শীতকালটায় গ্রামবাসীর মধ্যে থাকে এক অন্য ধরনের আমেজ। এতে করে নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার সমসখলসী নামে এই গ্রামটি এখন পরিচিত ‘পাখি গ্রাম’ হিসেবে। । দিন দিন ‘পাখি গ্রামের’ পরিচিতি বাড়তে থাকায় এখন অনেকেই আসেন পাখি দেখতে। এই পাখি গ্রামের মানুষেরাও প্রকৃতিপ্রেমী। পাখির প্রতি ভালোবাসা থেকে পাখি রক্ষায় নানা উদ্যোগও নিয়েছেন তারা। ফলে পাখির অভয়ারণ্য হয়ে ওঠা সমসখালীতে প্রতিদিন আসছেন পর্যটকরা।

নিভৃত এই গ্রামে ২০০৫ সালের দিকে প্রথম পরিযায়ী পাখির আনাগোনা শুরু হয়। সেইসঙ্গে আগে থেকেই এখানে দেশীয় প্রজাতির আধিক্য ছিল। প্রথম প্রথম অনেকেই আশপাশের গ্রাম থেকে এ গ্রামে পাখি শিকার করতে আসলেও এলাকাবাসীর বাধার মুখে ব্যর্থ হন। পরে পুরো গ্রামের লোকজন পাখি নিধন বন্ধে গ্রামের বিভিন্ন পয়েন্টে ব্যানার, সাইনবোর্ড টাঙান ও লিফলেট বিলি করেন। একপর্যায়ে পাখি রক্ষায় তারা স্থানীয় থানা পুলিশের সহায়তা নেন। পরবর্তী সময়ে গ্রামের যুবকরা নিজেদের উদ্যোগে গ্রামটিকে পাখির নিরাপদ আবাসস্থল (অভয়াশ্রম) হিসেবে ঘোষণা করেন। পাখির সার্বিক নিরাপত্তা ও বংশবিস্তারে স্থানীয় যুবকদের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘ইয়ুথ সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ নামে পরিবেশবাদী একটি সংগঠন।

ওই গ্রামের পাখি রক্ষায় রাজশাহী বন বিভাগের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ গ্রামবাসীকে নানাভাবে পরামর্শ ও সহযোগিতা করে আসছে। সমসখলসী গ্রামের পাখি সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারটি উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নজরদারি করা হচ্ছে। পাখি পরিচিতি ও পাখিপ্রেমীদের উদ্বুদ্ধ করতে খুব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

খোলাবাড়িয়া ঔষধিগ্রাম

নাটোর শহর থেকে পূর্বদিকে ১০ কিলোমিটার দূরে লক্ষীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নের খোলাবাড়িয়া গ্রামের লোকজন ভেষজ গাছের বাগান করে সফলতা এনেছে। বর্তমানে এ গ্রামের প্রায় ৮০% লোক এ পেশার সাথে জড়িত। প্রায় ১০০ প্রজাতির ঔষধি গুন সম্পন্ন ভেষজ চাষ করে গ্রামের প্রায় দেড় হাজার পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে, পাঁচ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ টাকা মূল্যমানের ভেষজ গাছ ও উপকরণ বিক্রয় হয়। উৎপাদিত ভেষজ দ্রব্যাদি প্রক্রিয়াজাতকরণ করে ঔষধ ও প্রসাধন শিল্প স্থাপনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। নাটোর সদর থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বে ঢাকা রাজশাহী মহাসড়কের পাশে অবস্থিত লক্ষ্মীপুর খোলাবাড়ীয়া ইউনিয়নের প্রায় ১৫টি গ্রাম নিয়ে গঠিত ঔষধী গ্রাম।

এলাকায় প্রবেশের সাথে সাথে রাস্তার দু‘ধারে দেখা যায় ঔষধী গাছের সমারোহ। ঔষধী গাছ গাছড়ার মধ্যে দুধসাগর, পাথরকুচি, কাশাবা, উলুটকমল, কর্ণপলাশ, শিমুল মূল, দাউদ মূল বাসক, তুলশি, ঘৃত কাঞ্চন, শতমুলি, শিমুল, অশ্বগন্ধা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও রয়েছে- বাসক, তুলসী, হরীতকী, বহেরা, তেলাকুচ, কেশরাজ, ধুতরা, পুদিনা, যষ্টিমধু, নিম, অর্জুন, ওলটকম্বল, লজ্জাবতী, হস্তী পলাশ, নিশিন্দা, রাজকণ্ঠ, নীলকণ্ঠ, হিমসাগর, দুধরাজ, ঈশ্বর মূল, রাহু চান্দাল, রক্ত চান্দাল, ভাই চান্দাল, বোন চান্দাল,  ভুঁইকুমড়া, আমরুল, কেয়ামূলসহ শত রকমের ঔষধি গাছ।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *