হাসার উদ-দীন কবিরত্ন

মো. হাসার-উদ-দীন কবিরত্ন (৮ নভেম্বর ১৯০৭ – ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৭) নাটোরের সাহিত্য অঙ্গনের এক বিশিষ্ট নাম। আজ নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি বিস্মৃতপ্রায় মানুষ হলেও সাহিত্যানুরাগী ও গুণীজনের কদর করেন এমন মানুষের কাছে তিনি পরম প্রিয়জন হিসেবে চির অম্লান ।

পরিচয় ও পরিবার

হাসার-উদ -দীন ৮ নভেম্বর ১৯০৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন কান্দিভিটুয়াতে। বাবা- মো. মছিরউদদীন (পূর্ব নিবাস বাগমারা) এবং মা- নাটোরের কান্দিভিটুয়ার মেয়ে ওয়াহেদুন্নেছা।

পরিবার

কবিরত্নের ছেলেদের মধ্যে নাটোর বড়গাছার বাকু (জি বি এম হাকিম উল ইসলাম) তাঁর সহজাত সুন্দর মানসিকতার জন্য সবার অতি প্রিয় ছিলেন। নাটোরের গুণী খেলোয়াড়দের মধ্যে তিনি প্রথম সারির। তিনি একজন উচ্চমানের দৌড়বিদ, ক্রিকেটার এবং ফুটবলার ছিলেন। সে সময় নাটোর কলেজের জমজমাট খেলার মাঠে বাকুর ছিল দৃপ্ত পদচারণা।

আরেক কৃতীসন্তান এফআরএম হাফিজ উল ইসলাম অবসরপ্রাপ্ত এমডি।

পড়াশোনা

সাংবাদিক, কবি, লিপিকুশল হাসার-উদ-দীন স্কুলজীবন থেকেই কাব্যসাধনায় মনোযোগী হন। প্রাথমিক শিক্ষা তিনি গ্রহন করেন মহল্লার পাটশালায়। তিনি মহারাজা উচ্চ বিদ্যালয় হতে ১৯২৮ সালে মহসিন বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্টিকুলেশন পাশ করেন। বর্তমান মহারাজা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় তখন আঞ্জামানিয়া মিডল ইংরেজি স্কুল নামে পরিচালিত । তাঁর চর্চায় উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিয়েছেন এই স্কুলের প্রধানশিক্ষক পুলিন গোস্বামী, বাংলার শিক্ষক জাফর আলী খান এবং নাটোরের স্বনামধন্য কবি, মেঘদূত অনুবাদক, নীহার ও নির্ঝর কাব্যের স্রষ্টা সংস্কৃতজ্ঞ ছান্দসিক কবি রঘুনাথ সুকুল ( জগদিন্দ্রনাথ তাঁকে উত্তরবঙ্গের রবীন্দ্রনাথ বলতেন)।

এরপর আই. এস. সি পাশ করেন রাজশাহী কলেজ থেকে। বাংলা, আরবি, উর্দু, ফারসি, ইংরেজি এবং সংস্কৃত ভাষাতে তিনি সমান পারদর্শি ছিলেন**

অমিত্রাক্ষর ধারার এই বিষ্ময়কবি মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় রচনা করেন জীবনের প্রথম সনেট কবিতা। ‘দয়ালু ঈশ্বর’ নামক কবিতাটি তৎকালিন ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি গেজেট’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

স্কুলে আবৃত্তি, বিতর্ক ছাড়াও ছবি আঁকা ও পোস্টার লেখাতে তিনি পারদর্শী ছিলেন। তাঁর সান্নিধ্যে নাটোরের মানুষ, শিল্প, সাহিত্য, জনজীবন ও শিক্ষা -সংস্কৃতির অনেক অজানা বিষয় জানার আগ্রহ ছিল তার। সাদাসিধা জীবনের এই মানুষ অপরিহার্য ছিলেন নাটোরের যেকোনো সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে। বক্তৃতা দিতেন চমৎকার। মুসলিম ইন্সটিটিউট, তৎকালীন জিন্নাহ স্কুল, কানাইখালি মাঠের পাশের আনসার হল, বালিকা বিদ্যালয়, রাইফেলস ক্লাব, ভিক্টোরিয়া পাবলিক লাইব্রেরি – সবখানেই তাঁর পদচারণা ছিল লক্ষণীয়।

কবিরত্ন হাসার নেতৃত্বেই ১৯৬১ সালে বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে ভিক্টোরিয়া পাবলিক লাইব্রেরিতে সপ্তাহব্যাপী রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন হয়। ১৯৬২ সন পর্যন্ত সরকারি চাকুরিজীবি ছিলেন। পেশাগত জীবনে বিভিন্ন দ্বায়িত্বশীল পদে আসিন থাকলেও মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন একজন কবি- আমাদের কবিরত্ন।

নাটোর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক “বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি গেজেট” পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয়। মাইকেল মধুসূদন দত্তের পর অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত তাঁর মধুপ্রশস্তি কবিতা রচনার জন্য তিনি ১৯৫৫ সালে যশোহর সাহিত্যসংহ কর্তৃক তিনি “কবিরত্ন” উপাধি লাভ করেন।মাইকেলের ছন্দের প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ ছিল। সে আকর্ষণের কথা তিনি অনেকবার বলেছেন।

তাঁর রচিত আরও কিছু প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ—

পূন্যস্মৃতি (১৩৮৪ বঙ্গাব্দ)

শক্তিমালা (১৩৮৫ বঙ্গাব্দ)

দ্বাদশী (১৩৯৩ বঙ্গাব্দ)

হিজরত (১৩৯৮ বঙ্গাব্দ)

এছাড়াও তিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচনা করেন ‘সন্ধানে’ নামক একটি একাঙ্ক নাটিকা(১৩৪১ বঙ্গাব্দ)

রচনা করেন গীতিনকশা ‘মোড়লের বিচার’ (১৩৪৩ বঙ্গাব্দ)

নাটোরের কাজী আবদুল মজিদের সাথে যুগ্ম-সম্পাদনায় প্রকাশ করেন “মালতী ” নামে একটি মাসিক পত্রিকা। দুটি সংখ্যার পর পত্রিকাটির অকালমৃত্যু ঘটে। নাটোর শহরের বড়গাছার ‘দীন মঞ্জিল’ কবির বসবাস ও লেখালেখির মনোরম স্থান। অসংখ্য কবিতা ও প্রবন্ধ লিখলেও প্রকাশিত হয়নি সব।

তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো সৌভাগ্য সোপান,গীতিনকশা,  মোড়লের বিচার,শুক্তিমালা,দ্বাদশী,হিজরত, মহোত্তম জীবন, সন্ধানে এবং তাঁর অপ্রকাশিত পান্ডুলিপির মধ্যে আছে হিলাল, বিষকুম্ভ, বেলুবন ইত্যাদি।

রসিক লেখক হিসেবেও তিনি সমাদৃত ছিলেন। পালপাড়ার শচীনন্দন পাল (১৮৯৬-১৯৭৯), লালবাজারের সাংবাদিক ও কবি গজেন্দ্রনাথ কর্মকার কাব্যরত্ন, সাহিত্যতীর্থ (মৃত্যু – ২১.১১.১৯৭৭) ও কান্দিভিটুয়ার অ্যাডভোকেট প্রদ্যোতকুমার লাহিড়ী ( ১২.১২. ১৯১২ – ৩.৩. ২০০৮ ) তাঁর বড় আপন ছিলেন।

এন.এস কলেজ মাঠের পূর্বপার্শের সড়কটির প্রান্তে নামফলকে লিখা রয়েছে- “মরহুম হাসার উদ্দীন কবিরত্ন সড়ক।”

নাটোরে কবির অবদান—

-তিনি “নাটোর মুসলিম ইনস্টিটিউট” এর রুপকার। ১০৩৭ সালে সহকর্মী ও জননেতা আব্দুল মজীদের সহযোগিতায় গঠন করেন “মুসলিম সাহিত্য সমিতি” যা পরবর্তীতে নাটোর মুসলিম ইনস্টিটিউটে রুপান্তরিত হয়।

-১৯২৫ সালে মাত্র অষ্টম শ্রেনীতে পড়া অবস্থায় সম্পাদনা করেন “মালতী” নামে একটি মাসিক পত্রিকার।

-১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন সেই সময়ের অন্যতম সাহিত্য পরিষদ “বরেন্দ্র সাহিত্য পরিষদ, নাটোর”

-১৯৩২ সালে “আলাইপুর পাকা মসজিদ সংস্কার সমিতি” গঠন করে মসজিদ সংস্কার করনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন।

-নাটোরের লা-ওয়ারিশ মূর্দাদের দাফনের জন্যে ১৯৩২ সালে গঠন করেন “বেরিয়াল ও জানাযা কমিটি”।

-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অসামান্য অবদানের জন্যে তিনি নাটোর ভিক্টোরিয়া পাবলিক লাইব্রেরির আজীবন সদস্য।

-এছাড়াও তিনি ছিলেন তৎকালিন “জিন্নাহ্ মেমোরিয়াল হাই স্কুল নাটোর” এর কার্যপরিসদের সদস্য। “নবাব সিরাজ উদ্ দৌলা সরকারী কলেজ” এবং “রানী ভবানী মহিলা মহাবিদ্যালয়” এর পরিচালক মন্ডলীর সদস্য।

-নাটোর জেলা সমিতি ঢাকা’র ১ম স্মরণিকায় হাসারউদ্দিন কবিরত্ন এর লেখা কবিতা। প্রকাশকাল ১৯ মে ১৯৮৯

সম্মাননা

১৯৫৫ সালে হাসার-উদ-দীন যশোহর সাহিত্যসংঘ কর্তৃক কবিরত্ন উপাধি ও ভিক্টোরিয়া ক্লাবে কিশোর সংঘ কর্তৃক সংবর্ধনা পান।

বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে অসামান্য অবদানের জন্যে ঢাকা সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদ থেকে ১৯৮৯ সালে লাভ করেন “জাতীয় আদর্শ পুরষ্কার স্বর্নপদক”।

কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকায় ২৬শে জানুয়ারি ১৯৯১ সালে ছাপা হয় তাঁর জীবন বৃত্বান্ত যার শিরোনাম ছিলো- “নাটোরের কবিরত্ন হাসার উদ্দীন”।

আমাদের কবিরত্ন শেষ জীবনে হারিয়ে ফেলেন তাঁর দৃষ্টিশক্তি। তবে দৃষ্টিশক্তি হারালেও তিনি কবিতা থেকে সরে যননি। দৃষ্টিশক্তিহীন অবস্থায় তাঁর কাব্যসঙ্গী হয়েছিলেন তাঁর নাতনী মোসাম্মাৎ আঞ্জুমান আরা। কবির পাশে থেকে তাঁর কাব্যছন্দগুলোকে স্বযত্নে লিপিবদ্ধ করে যেতেন তাঁর সুযোগ্য এই নাতনী।

কবির শেষ কবিতা যেটি তাঁর নাতনী লিপিবদ্ধ করেন সেটি এবার আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি—

নাটোর আমার জন্মভূমি

তোমায় আমি ভালোবাসি,

তোমার আকাশ তোমার বাতাস

আমার মুখে ফোটায় হাসি।

তোমার কোলে মেলেছিলাম

প্রথম আমার দুটি আঁখি;

তোমার বুকেই যেনো আবার

সর্বশেষ শুয়ে থাকি।

আল্লাহ্ মহান

তাঁর যা বিধান

অবশ্য হবে পূর্ন তাই;

তিনি প্রভু-

ভৃত্য আমি

আমার কোনো ইচ্ছা নাই।

তাঁর নিজ বাসভবন “দীন মঞ্জিল” বড়গাছা,নাটোরে তিনি ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৭ আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান। আমরা আমাদের গুণীজনের কথা ভুলে যাই। পঠন-পাঠনের স্পৃহা কমে গেছে আমাদের। বিভিন্ন অঞ্চল যেভাবে নিজেদের ঐতিহ্য নিয়ে চর্চায় বেগ সৃষ্টি করেছে, আমরা যেন তেমন করে এখনো জাগতে পারিনি। পাড়ার যেকোনো হিন্দু বিয়েতে তিনি উপহার হিসেবে দিতেন গীতা। আমার প্রিয়জন ও অভিভাবক মো. হাসার-উদ-দীন কবিরত্নের স্মৃতির প্রতি পরম শ্রদ্ধা।

( সূত্র – সমর পালের নাটোরের ইতিহাস ও হাসানাত কিরণ সম্পাদিত ফেসবুক পোস্ট )

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *